Best Seller Books

random/hot-posts

  মুজিযা কি ও কেন  ?   শব্দ পরিচিতি মুজিযা (معجزة) মূলঃ ع-ج-ز = عجز (আজয) , ضرب – يضرب – ضرباً – এর ওজনে। যথা عجز – يعجز – عجزاً এর যেমন ব্য...

 মুজিযা কি ও কেন ?

 

শব্দ পরিচিতি

মুজিযা (معجزة) মূলঃ ع-ج-ز = عجز (আজয) , ضرب – يضرب – ضرباً – এর ওজনে।

যথা عجز – يعجز – عجزاً এর যেমন ব্যবহার রয়েছে, তেমনি বাব-ই ইফআলের ওজনে তার ব্যবহার হয়ে থাকে।

মুজিযা শব্দটি উক্ত মূল থেকে উদ্ভূত একটি কর্তৃপদ (إسم فاعل) জাতীয় শব্দ। আসল রূপ معجزة (মুজিযা) তার ة বর্ণটি মুবালাগা (مبالغة) আধিক্য জ্ঞাপক অর্থের জন্য সংযুক্ত হয়েছে। সেটা স্ত্রীবাচক (تاء تانيث) তা (ة) নয়। তবে কারো কারো মতে, معجزة শব্দটি উহ্য বিশেষ্য (موصوف) শব্দের বিশেষণ (صفت)। আসল রূপ – اية معجزة (আয়াতুন মুজিযাতুন), অলৌকিক নিদর্শন। (দ্র. ফাতহুল বারী, ৬ খণ্ড; আর-রাগিব ইসফাহানী, আল-মুফরাদাত ফী গারীবিল কুরআন, শিরো.)

সাধারণত কোন কাজ সম্পাদনে অক্ষম ও অসমর্থ হওয়ার অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এটি القدرة (শক্তি) এর বিপরীত। এই অর্থে শব্দটির ব্যবহার পবিত্র কুরআনে একাধিক স্থানে পাওয়া যায়, যথা –

“…. সে বললো – হায় ! আমি কি এই কাকের মতোও হতে অক্ষম হলাম, যাতে আমার ভাইয়ের মৃতদেহ গোপন করতে পারি ? এরপর সে অনুতপ্ত হলো।” (সূরাহ আল-মাইদাহ, ৫ : ৩১)

এই অর্থে শব্দটির আরো ব্যবহার দেখুন আল-কুরআনের এ আয়াতসমূহে – ৬ : ১৩৪ ; ৮ : ৫৯ ; ৯ : ২-৩ ; ১০ : ৫৩ ; ১১ : ২০, ৩৩ ; ১২ : ৩১ ; ১৬ : ৪৬ ; ২২ : ৫১ ; ২৪ : ৫৭ ; ২৯ : ২২ ; ৩৪ : ৩৮ ; ৩৫ : ৪৪ ; ৩৯ : ৫১ ; ৪৬ : ৩২ ; ৭২ : ১২।

এই অর্থের সূত্র ধরেই শব্দটি পবিত্র কুরআনে বার্ধক্য বুঝানোর জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন –

“তখন তার স্ত্রী চিৎকার করতে করতে সামনে আসলো আর তার মুখ চাপড়িয়ে বললো – আমি তো বৃদ্ধা, বন্ধ্যা।” (সূরাহ আয-যারিয়াত, ৫১ : ২৯)

আরো দেখুন – সূরাহ হুদ, ১১ : ৭২

মোটকথা, মুজিযা শব্দের আভিধানিক অর্থ – “কোন কাজ সম্পাদনে অথবা কোন বিষয় প্রদর্শনে অক্ষম করা, অভিভূত করা।” (সুত্রঃ প্রাগুক্ত)

 

মুজিযার পারিভাষিক শব্দ

মুজিযার পারিভাষিক সংজ্ঞা বর্ণনায় বিশেষজ্ঞ আলিমগণের ভাষ্যসমূহে কিছু মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। তবে এই মতপার্থক্য একান্তই শব্দগত, সবগুলোর ভাবার্থ প্রায় এক ও অভিন্ন। মুজিযার কয়েকটি পারিভাষিক সংজ্ঞা নিচে উল্লেখ করা হলোঃ

আল্লামা ইবনে হাযার আসকালানী লিখেছেনঃ রাসুলগণ কর্তৃক সম্পাদিত সে সকল অলৌকিক বা অসাধারণ কার্যাবলীই মুজিযা, যার প্রতিযোগিতা করতে সমসাময়িক যুগের মানুষ ব্যর্থ হয়েছে। (ফাতহুল বারী, ৬ষ্ঠ খণ্ড)

শায়খ আবু হাফস উমার আন-নাসাফী লিখেছেনঃ মুজিযা হলো প্রচলিত সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রমী কাজ, যা একজন নবুওয়াতের দাবীদার কর্তৃক প্রকাশ পায়। নবুওয়াত অস্বীকারকারীদের চ্যালেঞ্জে তিনি তা সম্পাদন করেন এবং কাজটির প্রকৃতি এমন যে, অস্বীকারকারীদের পক্ষে সেরূপ কাজ সম্পাদন করা অসম্ভব। (শারহুল আকাইদিন নাসাফিয়্যা)

বিখ্যাত অভিধান গ্রন্থ “আল-মুজামুল ওয়াসীত” এ মুজিযার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছেঃ মুজিযা এমন অসাধারণ কাজ, যা আল্লাহ তাআলা তার প্রেরিত নবী-রসূলগণের দ্বারা সংঘটিত করে থাকেন। উদ্দেশ্য নবীর নবুওয়াতের সত্যতা প্রমাণ করা।

উপরে উল্লিখিত মুজিযার সংজ্ঞা তিনটির মর্ম প্রায় একই। তার সারসংক্ষেপ এই যে, মুজিযা বলা হয় –

(১) যা অসাধারণ, অস্বাভাবিক ও অলৌকিক,

(২) যা নবী-রাসুলগণের দ্বারা প্রকাশ পায়,

(৩) তবে তার সংঘটক স্বয়ং আল্লাহ তাআলা,

(৪) তা নবী-রাসুলগণের নবুওয়াত ও রিসালাতের দাবীর সত্যতার প্রমাণস্বরূপ,

(৫) তার মধ্যে নবী-রাসুলগণের পক্ষ থেকে বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি মুকাবিলার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হয়, তবে তারা তার মুকাবিলা করতে সক্ষম হয় না।

মুজিযার উল্লিখিত সংজ্ঞার আলোকে আল-ঈযী আল-মাওয়াকিফ গ্রন্থে লিখেছেন, যিনি আল্লাহ’র নবী তার নবুওয়াতের দাবীর সত্যতা প্রমাণ করাই মুজিযার উদ্দেশ্য। তবে যে কোন অসাধারণ ঘটনাই মুজিযা নয়, বরং তা মুজিযারূপে স্বীকৃত হওয়ার জন্য নিন্মোক্ত শর্তাবলীর উপস্থিতি অপরিহার্যঃ

(১) তা আল্লাহ’র কাজ হতে হবে,

(২) প্রচলিত সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম হতে হবে,

(৩) অনুরূপ কাজ সম্পাদন অন্যের পক্ষে অসম্ভব হতে হবে,

(৪) মুজিযা এমন ব্যক্তির মাধ্যমে সংঘটিত হবে, যিনি নিজেকে নবী বলে দাবী করেন যা তার সত্যতার প্রমাণস্বরূপ প্রকাশ পায়,

(৫) তার মাধ্যমে প্রকাশিত মুজিযাটি তার ঘোষণার সমর্থন জ্ঞাপক হতে হবে,

(৬) মুজিযা তার দাবীর পরিপন্থী হবে না,

(৭) মুজিযা দাবীর পরে সংঘটিত হতে হবে, পূর্বে নয়।

আল-ঈযীর মতে, মুজিযা এভাবে সংঘটিত হয় যে, আল্লাহ তাআলা নিজ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যার (নবী-রাসুল) সত্যতা প্রমাণ করতে চান তার মাধ্যমে তা ঘটিয়ে থাকেন। ফলে মুজিযা দর্শকদের মধ্যে নবী-রাসুলের সত্যতায় দৃঢ় বিশ্বাস ও প্রত্যয় সৃষ্টি করে। (আল-মাওয়াকিফ, মুজিযা অধ্যায়)

ইবন ইউসুফ সালিহী বলেন, মুজিযাকে মুজিযা বলে স্বীকার করার ক্ষেত্রে চারটি শর্তের আওতায় তাকে বিশ্লেষণ করতে হবে –

(১) যা স্বাভাবিক নিয়মনীতি ভঙ্গ করে সংঘটিত হবে, যেমন – চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়া, অঙ্গুলীসমূহ থেকে পানির ঝর্ণা প্রবাহিত হওয়া, লাঠি সাপে পরিণত হওয়া, প্রস্তরের মধ্য থেকে উস্ট্রী বের হওয়া ইত্যাদি।

(২) যা চ্যালেঞ্জের সাথে জড়িত। আবার অনেকে বলেছেন, যা চ্যালেঞ্জের সাথে জড়িত নয়। কারণ, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে স্বাভাবিক নীতিবিরুদ্ধ যে সকল ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তার অধিকাংশই চ্যালেঞ্জবিহীন। তাই যারা চ্যালেঞ্জের শর্ত আরোপ করেছেন, তাদের অভিমত সঠিক নয়। সমস্যাটির সমাধান এভাবে করা যেতে পারে যে, যখনই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াতের দাবী করেছেন, তখনই স্বাভাবিক নিয়ম ভঙ্গ করেই তা সংঘটিত হয়েছে। যখনই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দাবী করছেন – “আমি সৃষ্টি জগতের প্রতি আল্লাহ’র একজন রাসুল”, তখনই বুঝতে হবে স্বাভাবিক নিয়ম ভঙ্গ করেই এই দাবীটি করা হচ্ছে। মুখ্যত চ্যালেঞ্জ এখানে পরোক্ষভাবেই জড়িত। (শায়খ কামালুদ্দীন ইবনুল হুমাম, মাসীরাত)

(৩) যা নবুওয়াত ও রিসালাত প্রাপ্তির পূর্বে সংঘটিত হয়েছে। তাতে চ্যালেঞ্জ বা মুকাবিলার কোন উৎস থাকে না। এটি মুজিযা বলে অভিহিত নয় বরং কারামাত বলা যেতে পারে। যেমন – মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শৈশব অবস্থায় তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বক্ষ বিদারণ, কৈশোরাবস্থায় তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মেঘের ছায়াদান। শিশুকালে ঈসা আলাইহিস সালামের দোলনা থেকে কথা বলা। এটা নবী-রাসুলগণের নবুওয়াত ও রিসালাতের ভিত্তি।

(৪) যা দাবীদারের দাবীর স্বপক্ষে সংঘটিত হবে তা-ই মুজিযা, বিপক্ষে হলে মুজিযা নয়। যেমন – নবুওয়াতের দাবীদার দাবী করবেন যে, আমার নবুওয়াতের নিদর্শন হলো, আমার দাবীর স্বপক্ষে আমার হাত বা এই প্রাণী যার কথা বলবে। তার হাত বা প্রাণীটি যদি তার বিপক্ষে বলে এই লোকটি মিথ্যুক, সে নবী না। তা হলে তার হাত ও প্রাণীটি কথা বলা সত্ত্বেও তার বিপক্ষে সাক্ষী দিয়েছে বলে তা মুজিযা নয়। যেমন – মুসায়লামা কাযযাব একটি কূপে পানি বৃদ্ধির জন্য থুথু নিক্ষেপ করেছিলো, ফলে কূপটি ধ্বসে গিয়ে তার পানি উধাও হয়ে গিয়েছিলো।

এই চারটি শর্ত বহির্ভূত বিষয়গুলো মুজিযা নয়। তবে দাজ্জাল তার দুই হাতে স্বাভাবিক নীতি বিরুদ্ধ নিদর্শনসহ আগমন করবে, তাকে মুজিযা বলা যাবে না। কারণ সে নবুওয়াতের দাবীদার হবে না, বরং সে দাবীদার হবে প্রভুত্বের। (সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ৯খ.)

আল্লামা ইবন হাযার আসকালানীর মতেও নবী-রাসুলগণের দ্বারা সংঘটিত যে কোন অসাধারণ কর্মকাণ্ডই মুজিযা নয়, বরং তিনি এ ক্ষেত্রে দুটো পরিভাষা স্থির করেছেন – মুজিযা, আর আলামাতুন নুবুওয়াত (নবুওয়াতের নিদর্শন বা চিহ্ন)। যে সকল অসাধারণ কাজের মাধ্যমে নবী-রাসুলগণ বিরুদ্ধবাদীদেরকে চ্যালেঞ্জ করে থাকেন, কেবল তা-ই মুজিযা। যেমন তিনি বললেন, “যদি আমি এই কাজ করতে পারি, তবে আমি নবী, অন্যথা আমি মিথ্যাবাদী।” পক্ষান্তরে নবুওয়াতের আলামত ও নিদর্শনের মধ্যে কোন চ্যালেঞ্জ থাকে না, মুকাবিলার আহবান থাকে না। (ফাতহুল বারী, ৬ খণ্ড)

পবিত্র কুরআনে মুজিযা শব্দটি আভিধানিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, পারিভাষিক অর্থে নয়। মুজিযা অর্থ প্রকাশের জন্য পবিত্র কুরআনে “আয়াত” (اية) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, বহুবচনে “আয়াত” (ايات) এবং “আই” (اي)। এর অর্থ কোন বস্তু চিনার উপায় বা নিদর্শন। এই চিহ্ন বা নিদর্শন বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। যথা, আল্লাহ’র অস্তিত্ব ও তার একত্ব প্রমাণের জন্য সমগ্র সৃষ্টি একটি প্রমাণ বা নিদর্শন। এই অর্থে “আয়াত” এর ব্যবহার এরুপঃ

وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ آيَتَيْ

“আর আমি রাত ও দিনকে করেছি দুটো নিদর্শন ….” (সূরাহ বানি ঈসরাঈল, ১৭ : ১২)

আরো দেখুনঃ ৩০ : ২২-২৫, ৪৬ ; ১০ : ৬ ; ২ : ৭৩, ১৮৭ ; ৩ : ১৯০।

অনুরূপ, নবীগণের নবুওয়াতের সত্যতার প্রমাণ হিসেবে শব্দটি অসাধারণ কাজ ও অলৌকিক বিষয় বুঝানোর অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে।

وَلَئِنْ أَتَيْتَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ بِكُلِّ آيَةٍ مَّا تَبِعُوا قِبْلَتَكَ

“যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে আপনি যদি তাদের কাছে সমস্ত দলীল পেশ করেন, তবুও তারা আপনার কিবলা মেনে নিবে না ……..” (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ : ১৪৫)

আরো দেখুনঃ ২ : ২১১, ২৪৮, ২৫৯ ; ৩ : ৪৯, ৫০ ; ৫ : ১১৪ ; ৬ : ২৫, ১২৪ ; ৭ : ৭৩, ১০৬, ১৩২, ১৪৬।

 

অবশ্য আয়াত শব্দটির ব্যবহার পবিত্র কুরআনে উক্ত দুটো অর্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং শব্দটি এটি ছাড়া অন্যান্য অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, উপদেশ ও শিক্ষণীয় অর্থে, যথা, আল-কুরআনে আছেঃ

إِنَّ آيَةَ مُلْكِهِ

“…. তার রাজত্বের নিদর্শন এই যে ….. ” (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ : ২৪৮)

আরো দেখুনঃ ৩ : ১৩; ১০ : ৯২; ১১ : ১০৩,

 

এবং কুরআনের আয়াত অর্থেও ব্যবহৃত হয়, যেমন – আল কুরআনে আছেঃ

وَلَا تَشْتَرُوا بِآيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلًا

“…. তোমরা আমার আয়াতের বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করিও না …..” (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ : ৪১)

আরো দেখুনঃ ২ : ৯৯, ১০৬, ২২১, ২৫২ ; ৬ : ৪, ১২৪ ; ১৬ : ১০১ ; ৩৬ : ৪৬ ; ৪৫ : ৩১ ; ৬২ : ২ ; ৮৩ : ১৩।

“আয়াতুন” শব্দটি “মুজিযা” শব্দ অপেক্ষা অধিক ব্যাপক অর্থ প্রকাশ করে। সুতরাং বলা যায়, পবিত্র কুরআনে “মুজিযা” শব্দ ব্যবহৃত না হয়ে বরং “আয়াতুন” শব্দ ব্যবহৃত হওয়ায় নবী-রাসুলগণের মুজিযা ও তাদের আলামতে নবুওয়াত উভয়বিধ বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত। “মুজিযা”‘র অর্থ বুঝাতে পবিত্র কুরআনে আরো একটি শব্দের ব্যবহার পরিদৃষ্ট হয়, তা হলো “বুরহান” (برهان) শব্দ। এর অর্থ অকাট্য এবং সুস্পষ্ট দলীল ও প্রমাণ। আল-মুজামুল ওয়াসীতে এর অর্থ বলা আছে, “সুস্পষ্ট পার্থক্যকারী প্রমাণ।” যথাঃ পবিত্র কুরআনে মুসা আলাইহিস সালামের মুজিযা প্রসঙ্গে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন –

“যখন মুসা আগুনের কাছে পৌঁছালো, তখন উপত্যকার দক্ষিণ পার্শ্বে পবিত্র ভূমিস্থিত এক বৃক্ষের দিক থেকে তাকে আহবান করে বলা হলো – হে মুসা, আমিই আল্লাহ, জগতসমূহের প্রতিপালক। আরো বলা হলো – তুমি তোমার লাঠি নিক্ষেপ করো। এরপর সে যখন সেটাকে সাপের মতো ছুটাছুটি করতে দেখলো, তখন পিছনের দিকে ছুটতে লাগলো এবং ফিরে তাকালো না। তাকে বলা হলো – হে মুসা, সামনে আসো, ভয় করো না, তুমি তো নিরাপদ; আর তোমার হাত বগলে রাখো, এটি বের হয়ে আসবে শুভ্র সমুজ্জল নির্দোষ হয়ে। ভয় দূর করার জন্য তোমার হাত দুটো নিজের দিকে চেপে ধরো। এ দুটো তোমার প্রতিপালক প্রদত্ত প্রমাণ, ফিরাউন ও তার পরিষদবর্গের জন্য, তারা তো সত্যত্যাগী সম্প্রদায়।” (সূরাহ আল-কাসাস, ২৮ : ৩০-৩২)

সারকথা এই যে, নবুওয়াত ও রিসালাতের দায়িত্ব পালনকারীগণের হাতে কখনো কখনো মানবিক শক্তির অতীত কর্মকাণ্ড সাধিত হয়, যা পূর্ণাঙ্গভাবে অনুধাবনে মানবিক প্রজ্ঞা ও মনীষা অপারগ হয়ে যায়। যেমন – ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের উপর আগুন শীতল হয়ে যাওয়া, মুসা আলাইহি ওয়া সাল্লামের লাঠি সাপে পরিণত হওয়া, ঈসা আলাইহিস সালামের হাতে মৃত জীবিত হওয়া, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক রাতে পবিত্র কাবাঘর থেকে আল-বায়তুল মুকাদ্দাস, এরপর সেখান থেকে সিদরাতুল মুনতাহা, এরপর আল্লাহ’র অদৃশ্য জগত পরিদর্শন করা ইত্যাদি। এ সমস্ত ঘটনার মর্মোদঘাটন আর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে মানবিক জ্ঞান-বুদ্ধি একান্তই অপারগ। আল-কুরআনের ভাষায় এই সমস্ত ঘটনার নাম বুরহান (برهان), বায়্যিনাত (بينات)। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি আয়াত (ايات) অথবা আয়াতুম বায়্যিনাত (ايات بينات) রূপেও ব্যবহৃত হয়েছে। মুহাদ্দিসগণ এ সমস্ত হাদিসকে “দালাইলুন নুবুওয়াত” বলে অভিহিত করে থাকেন। আর আকাইদ বিশেষজ্ঞ (মুতাকাল্লিমুন) ও দার্শনিকদের পরিভাষায় একে মুজিযাত বলা হয়।

 

মুজিযার তাৎপর্য

নবুওয়াতের দাবীদার নিজ গোত্রের সন্তানদেরকে যে আমন্ত্রণ জানান আর এই জগতের বুকে যে পয়গাম ছড়িয়ে দেন, তার সত্যতার সমুজ্জ্বল প্রমাণ বা নিদর্শন যদিও স্বয়ং পয়গাম বা পয়গামবাহকের অস্তিত্ব, তথাপি সংশয়ী চিত্তের স্বস্তির প্রয়োজনে প্রমাণে পূর্ণতা সম্পাদনের উদ্দেশ্যে সত্যের আহবায়কের দ্বারা এমন কিছু কার্যাবলী প্রকাশ পায়, যা সাধারণ মানুষের ক্ষমতা বা ধ্যান-ধারণার ঊর্ধ্বে।

ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের ক্ষেত্রে আগুন শীতল হয়, মুসা আলাইহিস সালামের হাতের লাঠি পরিণত হলো অজগর সাপে, পিতাবিহীন সন্তানের অস্তিত্ব হলেন ঈসা আলাইহিস সালাম, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা এরপর সেখান থেকে সিদরাতুল মুনতাহা পরিভ্রমণ করে আসেন স্বল্প সময়ে। মানববুদ্ধি যেহেতু এগুলোর ব্যাখ্যা প্রদান করতে অক্ষম, তাই এতে এক অদৃশ্য শক্তির ক্রিয়া ধরা পড়ে। যে ব্যক্তির উদ্দেশ্যে এটি প্রকাশ পায়, অদৃশ্যের জ্ঞানসহ অন্যান্য নিদর্শনাদি যার সহায়ক হয়, তাকে অদৃশ্য সাহায্যপ্রাপ্ত বলে ধরা হয়। কুরআন মাজিদ এ সকল ঘটনা নাম দিয়েছে “বায়্যিনাত”, “বারাহীন” এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে “আয়াত”। মুহাদ্দিসগণ সেগুলোকে “দালাইলুন নুবুওয়াত” আখ্যা দিয়েছেন। দার্শনিকগণের পরিভাষায় সেগুলোর নাম হলো “মুজিযা” বা অস্বাভাবিক কার্যাবলী। (সায়্যিদ সুলায়মান নদবী, সিরাতুন-নবী, ৩খ.)

 

মুজিযার স্বরূপ

আল্লাহ তাআলা কোন নিয়ম, উপকরণ, কার্যকরণ নীতি ছাড়াই যে কোন বস্তুকে অস্তিত্বে আনতে সক্ষম। মুজিযা প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও তেমনই কোন নিয়মনীতির প্রয়োজন নেই। যখনই তিনি ইচ্ছে করেন, তখনই তিনি মুজিযা প্রদর্শন করেন। তবে এটি মানবিক শক্তির ঊর্ধ্বে। এটি শিক্ষা করার উদ্দেশ্যে কোন শিক্ষাগার, পাঠাগার, পরীক্ষাগার বা পাঠ্যসুচি তৈরি করাও সম্ভব না। মুসা আলাইহিস সালামের লাঠি দিয়ে লক্ষবার মাটিতে আঘাত করলেও আর ঝর্ণা প্রবাহিত হবে না, লক্ষবার মাটিতে নিক্ষেপ করলেও তা সাপে পরিণত হবে না, শুধু আল্লাহ’র ইচ্ছে হলেই তা সম্ভব হবে। আবার যে নবীর মাধ্যমে মুজিযা প্রদর্শিত হবে, তিনি নিজেও অনবহিত যে, কখন ও কিভাবে মুজিযা প্রদর্শিত হবে। কারণ মুজিযা প্রদর্শনের জন্য কোন সুনির্ধারিত নিয়মকানুন বা সময় নেই। দেখা গেছে, ফিরআউন ও তার নিজ জাতির সামনে মুসা আলাইহিস সালাম তার হাতের লাঠিটি মাটিতে ফেলে দিলেন। সাথে সাথে লাঠিটি বিরাট একটি অজগর সাপে পরিণত হলো আর ফোঁস ফাঁস, লম্ফঝম্ফ করতে লাগলো। মুসা আলাইহিস সালাম নিজেও ভীত-সন্ত্রস্ত হলেন। আল্লাহ নির্দেশ দিলেন –

“তিনি বললেন – তুমি একে ধরো, ভয় করো না, আমি একে এর পূর্বরূপে ফিরিয়ে দিবো।” (সূরাহ তা-হা, ২০ : ২১)

মুসা আলাইহিস সালাম যদি পূর্ব থেকেই জানতেন যে, লাঠি ছেড়ে দিলে সাপে পরিণত হবে, তাহলে তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত হতেন না।

মুজিযার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। এই জগতে প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতার খেলা চলছে। দেখা যায় যে, কেউ যদি কোন কিছু আবিস্কার-উদ্ভাবন করে, তখন অপর একজন তার প্রতিযোগিতায় তার চেয়ে উন্নততর আবিস্কারে মেটে উঠেছে। কিন্তু মুজিযার ক্ষেত্রে তেমনটি চিন্তা-ভাবনারও ঊর্ধ্বে। মহাপ্রলয়কাল পর্যন্ত সংগ্রাম করেও কেউ মুজিযার অনুরূপ কিছু প্রদর্শন করতে সক্ষম হবে না। উড়োজাহাজ আকাশে উড়ে চলে মেশিনের সাহায্যে, আরো উন্নততর মেশিনের সাহায্যে রকেট চলে। পক্ষান্তরে সুলায়মান আলাইহিস সালামের তখত- সিংহাসন আকাশে উড্ডীয়মান হয় মেশিন ছাড়াই, আল্লাহ’র ইচ্ছার দ্বারা। অনুরূপ মেশিন ছাড়া উড়া কি আর কারো পক্ষে সম্ভব হয়েছে ? মানবিক শক্তি ও জগতের যাবতীয় শক্তি মুজিযার ক্ষেত্রে অচল, অকার্যকর। বস্তুত মুজিযা উপাত্ত-উপকরণ বহির্ভূত আল্লাহ’র গোপন ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ।

 

মুজিযা কখন ও কিভাবে সংগঠিত হয় ?

মুজিযা দুইভাবে সংগঠিত হয়ে থাকে –

(১) তলবী (طلبي) : মানুষের মুজিযা প্রদর্শনের দাবীর প্রেক্ষিতে। এর প্রকাশ এভাবে হয় যে, বিরুদ্ধবাদীরা নবী-রাসুলকে মিথ্যাবাদী মনে করে। তাই তার নিকট অতি প্রাকৃত কিছু ঘটানোর দাবী জানায়। তারা মনে করে যে, পয়গাম্বর তা কখনো প্রদর্শন করতে সক্ষম হবেন না। ফলে তাকে মানুষের সামনে লজ্জিত ও অপমানিত হতে হবে। তখন আল্লাহ তা উপযোগী মনে করলে তা পয়গাম্বরের হাতে অতি প্রাকৃত ঘটনার প্রকাশ ঘটান। আর তখন তার ফলে দাঁড়ায় বিপরীতমুখী। পয়গাম্বরের লজ্জিত ও অপমানিত হওয়ার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হয় তার সত্যতা ও যথার্থতা। যেমন – ফেরাউন যাদুকরদের সমবেত করে মুসা আলাইহিস সালাম’কে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করতে এবং তাকে জনসম্মুখে লজ্জিত ও অপমানিত করতে চেষ্টা চালিয়েছিলো। কিন্তু আল্লাহ’র কুদরতে মুসা আলাইহিস সালামের লাঠি সাপে পরিণত হওয়ার মুজিযা সংগঠিত হলো। ফলে ঘটনাটি পরিণামে মুসা আলাইহিস সালামের লজ্জা ও অপমানের পরিবর্তে তার সফলতা ও তার মিশন বিজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। তার নবুওয়াতের দাবীর সত্যতা জনসম্মুখে সূর্যের মতো উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। পরিণামে উপস্থিত যাদুকরগণ তার নবুওয়াতে বিশ্বাসী হয়ে ঈমানদার হয়ে গেলো। (দেখুনঃ সূরাহ আল-আরাফ, ৭ : ১০৩-১২৬)

আরিফ রুমী তার মসনবীতে চমৎকার বলেছেনঃ অবিশ্বাসীরা মুজিযা তলবের মাধ্যমে সত্যকে নিস্প্রভ করে দিতে চায়, অথচ তাদের এই অপচেষ্টার ভিতর দিয়েই সত্যের বিজয় ও যথার্থতা পরিস্ফুটিত হয়ে উঠে। তাদের ইচ্ছে ছিল মুজিযা তলব করে পয়গাম্বরকে লজ্জিত ও অপমানিত করা। কিন্তু তাদের এই পায়তারাই পয়গাম্বরের মর্যাদাকে উদ্ভাসিত করে তোলে। (মসনবীর বরাতে সিরাতুন্নবী, ৪র্থ খণ্ড)

(২) গায়রে তলবী (غير طلبي) – অর্থাৎ মানুষের পক্ষ থেকে মুজিযার দাবী করা ছাড়াই আল্লাহ নিজ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যার (নবী-রাসুল) সত্যতা প্রমাণ করতে চান, তারই দ্বারা কোন অসাধারণ কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে থাকেন, যাতে সেটি তার নবুওয়াত ও রিসালাতের প্রমাণ হিসেবে দর্শকদের মধ্যে প্রভাব ও প্রত্যয় সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। যেমন – খাবারের মধ্যে বরকতের মুজিযা। এটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে প্রদত্ত ঐতিহাসিক মুজিযা। খন্দকের যুদ্ধের সময় মুসলমানগণ চরম আর্থিক সংকট এবং অনাহারের মধ্যে জীবন যাপন করছিলেন। এমনকি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্ষুধায় কাতর হয়ে কটিদেশ সোজা করতে পারছিলেন না, তাই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পেটে পাথর বেঁধে খন্দক খননের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অন্যান্য সাহাবীদের অবস্থাও ছিল অনুরূপ। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই অবস্থা দেখে জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু তার ঘরে গিয়ে তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন – ঘরে খাবার আছে কি ? স্ত্রী বললেন – এক সা অর্থাৎ প্রায় সোয়া তিন কিলো গম আছে। এরপর জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু তার ঘরে পালিত একটি ছাগল জবাই করে স্ত্রীকে রুটি ও গোশত পাকানোর নির্দেশ দিলেন। এরপর তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খিদমতে হাজির হয়ে অতি সন্তর্পণে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো দুই তিনজন সাহাবীসহ তার ঘরে রুটি ও গোশতের দাওয়াত গ্রহণের জন্য সবিনয় অনুরোধ করলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দাওয়াত কবুল করলেন আর উচ্চস্বরে ডেকে বললেন – হে পরিখা খননকারী, জাবির তোমাদেরকে দাওয়াত করছে, তোমরা সকলে তার ঘরে চলে আসো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই আহবান শুনে জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রমাদ গুনতে লাগলেন। মাত্র এক সা গমের রুটি আর একটি ছাগলের গোশত দিয়ে সহস্রাধিক মেহমানকে কিভাবে পরিতুষ্ট করবেন, তিনি তা-ই ভাবছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু’র রন্ধনশালায় প্রবেশ করে উনুনের উপর চড়ানো গোশতের হাড়িতে এবং খমীর করা আটায় পবিত্র মুখের লালা মিশ্রণ করে বললেন – সমস্ত মেহমানের আহার গ্রহণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত চুলার উপর থেকে হাঁড়ি নামিও না। আর এই খামীর থেকে অল্প অল্প করে আটা নিয়ে রুটি তৈরি করতে থাকো। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করা হলো। ফলে সহস্রাধিক মেহমানকে আহার করানোর পরও দেখা গেলো, যে পরিমাণ আটা খামীর করা হয়েছিলো, এখনো সেই পরিমাণই অবশিষ্ট রয়েছে এবং হাঁড়ি পূর্ববৎ গোশতে পরিপূর্ণই আছে। (বুখারী, ২য় খণ্ড)

 

মুজিযার প্রকারভেদ

নবী-রাসুলগণকে আল্লাহ তাদের নবুওয়াত ও রিসালাতের দাবীর স্বপক্ষে যে প্রমাণ তথা মুজিযা প্রদান করেছেন, তা প্রথমত দুই প্রকারের – জাহেরী বা বস্তুভিত্তিক এবং বাতেনী বা আত্মিক। জাহেরী ও বস্তুভিত্তিক মুজিযা, যেমন মৃতকে জীবিত করা, লাঠিকে সাপে পরিণত করা, আঙ্গুল থেকে পানির প্রবাহ জারী হওয়া, রুগ্নকে সুস্থ করা, চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করা, সমুদ্র বক্ষে চলার পথ তৈরি হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। আর বাতেনী ও আত্মিক (রূহানী) মুজিযা হচ্ছে – নবুওয়াতের দাবীদারের সত্যতা, নবীগণের নিস্পাপ ও পবিত্র হওয়া, তাদের প্রভাব শক্তি, সফলতা ও গায়বী সাহায্য ইত্যাদি। এর মধ্যে পবিত্র কুরআন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যতম বাতেনী মুজিযা। বস্তুত নবুওয়াত ও রিসালাতের আসল ও মৌলিক প্রমাণ হচ্ছে এই সমস্ত আত্মিক ও রূহানী নিদর্শন। আর জাহেরী ও বস্তুভিত্তিক মুজিযাসমূহ শুধুই আবরণ এবং বাইরের প্রতি দৃষ্টি দানকারীদের জন্য। এ কারণে দেখা যায়, যারা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন গূঢ় মর্মজ্ঞানী, তার কখনো জাহেরি মুজিযা তলব করেন নাই। অনুরূপ নবী-রাসুলগণের যুগে যারা শিক্ষিত সমাজ হিসেবে পরিচিত ছিল, তারাও নবী-রাসুলগণের কাছে কোন জাহেরী মুজিযা দাবী করেন নাই। উদাহারনস্বরূপ, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগের আহলে কিতাবগণ। তারা সন্দেহপ্রবণ মনে নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে বারবার উপস্থিত হয়েছে, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সত্যতার প্রমাণ নিয়েছে। কিন্তু তাদের পরীক্ষার বিষয়বস্তু কি ছিলো ? তা ছিলো এই যে, তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র চরিত্র ও আখলাক পরীক্ষা করেছিলো। তারা অতীতের বনী ইস্রাইলী নবী-রাসুলের অবস্থাসমূহ ও ঘটনাবলী জিজ্ঞাসা করেছিলো এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষা ও উলুমের ভাণ্ডার পর্যালোচনা করেছিলো। কিন্তু তাদের মধ্য থেকে কেউই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জাহেরী মুজিযা তলব করেনি। কারণ তারা জানতো যে, নবুওয়াতের দাবীর সত্যতার আসল ও মৌলিক প্রমাণ হচ্ছে দাবীদারের আধ্যাত্মিক ও অভ্যন্তরীণ দিক এবং তার আখলাক ও চারিত্রিক অবস্থা। ঠিক একই কারণে আমরা দেখতে পাই যে, তৎকালীন খৃষ্ট ধর্মবলম্বী রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের দরবারে যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দূত দিহইয়া কালবী রাদিয়াল্লাহু আনহু উপস্থিত হলেন আর সম্রাটের কাছে ইসলামের দাওয়াত পত্র পেশ করলেন, তখন হিরাক্লিয়াস রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের দাবীর সত্যতা যাচাই করার জন্য কুরাইশ সর্দার আবু সুফিয়ানকে রাজ দরবারে ডাকিয়ে এনে কিছু প্রশ্ন করেছিলেন। তার এই প্রশ্নগুলোর সমস্তটাই ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা, ব্যক্তিত্ব, চরিত্র ও প্রভাব সম্পর্কে। সবশেষে হিরাক্লিয়াস বলেছিলেন – তুমি (আবু সুফিয়ান) যা বলেছো তা যদি সত্য হয়, তবে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবশ্যই আল্লাহ’র প্রেরিত নবী ও রাসুল। (বুখারী, ১০ম খণ্ড)

অনুরূপ নাজরানের খৃষ্টান বিদ্বানগণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাযির হয়ে কুরআনের আয়াতসমূহ শুনলো আর মুসলমানদের আত্মিক বিকাশের অবস্থা লক্ষ্য করলো। এরপর তারা ঈসা আলাইহিস সালাম সম্বন্ধে ইসলামের সিদ্ধান্ত কি তা জানতে চাইলো। সবশেষে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল-কুরআনের হুকুম মুতাবিক তাদের সাথে মুবাহালা করতে চ্যালেঞ্জ প্রদান করলেন। কিন্তু তারা এতে সম্মত হলো না। তারা পরস্পর বলতে লাগলো – প্রকৃতই যদি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবী হোন, তাহলে আমরা সবংশে ধ্বংস হয়ে যাবো। পরিশেষে তারা বাৎসরিক খারাজ আরায় করার শর্তে সন্ধি স্থাপন করলো। লক্ষ্য করুন, তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সার্বিক শিক্ষা ও তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আখলাক-চরিত্র ও আচার-অনুষ্ঠান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে, কিন্তু দাবী প্রমাণের জন্য বাহ্যিক বস্তুভিত্তিক কোন মুজিযা তলব করে নাই। (যাদুল মাআদ, ৩য় খণ্ড)

স্বয়ং আরবের চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গের কথা পর্যালোচনা করে দেখুন। তাদের হাজারো ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের দাবীর সত্যতা স্বীকার করেছেন, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি ঈমান এনেছেন। অথচ তারা কেবল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাতেনী ও আত্মিক মুজিযা অনুধাবন করেছেন, তাদের একজনও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জাহেরী ও বস্তুভিত্তিক মুজিযা দাবী করেন নাই। যথা – খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা, আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু, উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু, উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু, আম্মার রাদিয়াল্লাহু আনহু, ইয়াসির রাদিয়াল্লাহু আনহু, আবু যর গিফারী রাদিয়াল্লাহু আনহু, বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রমুখ সাহাবা-ই কিরাম। আবু যর গিফারী রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত প্রাপ্তির কথা জানতে পারলেন, তখন নিজের ভাইকে বললেন – ঐ ব্যক্তির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে যাও, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দাবী করেছেন যে, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে আসমান থেকে ওহী এসেছে, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবস্থা পর্যবেক্ষণ করো। তার ভাই মক্কায় আসলেন আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে দেশে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং আবু যর গিফারী রাদিয়াল্লাহু আনহু’কে বললেন – আমি তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দেখেছি, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সচ্চরিত্রের নির্দেশ দেন এবং তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমন কালাম পেশ করেন যা কবিতা নয়। (মুসলিম, ২য় খণ্ড)

জাফর রাদিয়াল্লাহু আনহু আবিসিনিয়ায় নাজাশীর দরবারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের পরিচয় সম্বন্ধে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন – হে সম্রাট, আমরা ছিলাম অজ্ঞ ও জাহিল সমাজ। আমরা মূর্তিপূজা করতাম, মৃত জীব ভক্ষণ করতাম, দুষ্কর্মে লিপ্ত ছিলাম, প্রতিবেশীদের উপর অবিচার করতাম, পরস্পর হানাহানি ও মারামারি করতাম, দুর্বল লোককে সবল লোক নিশ্চিহ্ন করে দিতো। এমন অমানিশা ও দুর্যোগের সময় আমাদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবির্ভূত হলেন, যার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভদ্র ও শিষ্ট আচরণ, সততা, ন্যায়ানুবর্তিতা সম্পর্কে আমরা পূর্বেই জ্ঞাত ছিলাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে ইসলামের পথে আহবান করলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে এই শিক্ষা দিলেন যে, আমরা যেন মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করি, সত্য কথা বলি, রক্তপাত থেকে বিরত থাকি, ইয়াতিমের অধিকার হরণ না করি, প্রতিবেশীদের কষ্ট না দেই, সতী রমণীদের প্রতি যিনার মিথ্যা অপবাদ আরোপ না করি, নামায আদায় করি, যাকাত প্রদান করি, সিয়াম পালন করি। আমরা এ সমস্ত কথার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি, শিরক বর্জন করেছি, সকল প্রকার অপকর্ম পরিত্যাগ করেছি। (ইবন হিশাম, ১ম খণ্ড; মুসনাদ আহমাদ ইবন হাম্বল, ১ম খণ্ড)

আলোচনার সারাংশ এই যে, নবুওয়াত ও রিসালাতের আসল ও মৌলিক দলীল হচ্ছে, নবী-রাসুলগণের বাতেনী ও আধ্যাত্মিক মুজিযা ও নিদর্শনাবলী। তবে তাদের জাহেরী ও বস্তুভিত্তিক মুজিযাও ছিলো। তাই পবিত্র কুরআনে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আল্লাহ অতীত নবী-রাসুলগণের জীবনেতিহাস বর্ণনার প্রেক্ষাপটে তাদের জাহেরী মুজিযার বিস্তৃত বর্ণনা পেশ করেছেন। তথা – মুসা আলাইহিস সালামের লাঠি সাপে পরিণত হওয়া, তার হাত শুভ্র আলোকোজ্জ্বল হওয়া, সালিহ আলাইহিস সালামের সময়ে পাথরের মধ্য থেকে উস্ট্রী বের হয়ে আসা, ঈসা আলাইহিস সালামের হাতে মৃত ব্যক্তির জীবিত হয়ে যাওয়া, অসুস্থ ব্যক্তির সুস্থ হওয়া ইত্যাদি। নবীগণের জাহেরী ও বাতেনী মুজিযার আরো একটি পর্যালোচনা এই যে, জাহেরী বস্তুভিত্তিক মুজিযা শুধু ঐ সমস্ত লোক তলব করে যাদের অন্তরচক্ষু অন্ধ আর যারা বিরুদ্ধতাবাদীতা, পক্ষপাতিত্ব ও কূপমণ্ডূকতাসুলভ মনোভাবের কারণে সত্যকে মেনে নিতে রাজি হয় না। বস্তুত গোঁড়া কাফিররাই জাহেরী মুজিযা তলব করে থাকে। এ কারণে দেখা যায়, পবিত্র কুরআনে মুজিযা তলব সংক্রান্ত দাবীগুলোকে সর্বদা কাফিরদের প্রতিই আরোপ করা হয়েছে, যেমন –

“এবং যারা কিছু জানে না তারা বলে, আল্লাহ আমাদের সাথে কথা বলেন না কেন, কিংবা কোন নিদর্শন আমাদের কাছে নিয়ে আসে না কেন ? এভাবে তাদের পূর্ববর্তীরাও তাদের অনুরূপ কথা বলতো; তাদের অন্তর একই রকম; আমি দৃঢ় প্রত্যয়শীলদের জন্য নিদর্শনাবলী স্পষ্টভাবে বিবৃত করেছি।” (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ : ১১৮)

“তারা বলে, তার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তার কাছে কোন নিদর্শন নাযিল করা হয় না কেন ? বলো, নিদর্শন নাযিল করতে আল্লাহ অবশ্যই সক্ষম, কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না।” (সূরাহ আল-আনআম, ৬ : ৩৭)

“যারা কুফরি করেছে তারা বলে, তার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তার কাছে কোন নিদর্শন নাযিল করা হয় না কেন ? তুমি তো কেবল সতর্ককারী এবং প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য আছে পথপ্রদর্শক।” (সূরাহ আর-রদ, ১৩ : ৭)

“তারা বলে, সে তার প্রতিপালকের কাছ থেকে আমাদের কাছে কোন নিদর্শন আনে না কেন ? তাদের কাছে কি আসেনি সুস্পষ্ট প্রমাণ, যা আছে পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহে ?” (সূরাহ তো-হা, ২০ : ১৩৩)

উল্লিখিত আয়াতসমূহে লক্ষণীয় যে, প্রত্যেক আয়াতেই মুজিযা তলব করার বিষয়টি কাফিরদের প্রতি আরোপ করা হয়েছে। পুণ্যবানগণ কখনো মুজিযা তলব করেননি। এটা থেকে এ কথাও প্রমাণিত হয় যে, মুসা আলাইহিস সালাম’কে প্রদত্ত মুজিযা বনী ইস্রাইলের দাবীর প্রেক্ষিতে দেওয়া হয়নি, বরং ফিরাউন ও তার অনুসারীদের দাবীর প্রেক্ষিতে দেওয়া হয়েছিলো। তাই যখন হাওয়ারীগণ ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে খাদ্যভর্তি আসমানী খাঞ্চার জন্য বললো –

“…… হে মরিয়ম-পুত্র ঈসা, আপনার পালনকর্তা কি এরূপ করতে পারেন যে, আমাদের জন্য আসমান থেকে খাদ্যভর্তি খাঞ্চা অবতরণ করে দিবেন ? ……” (সূরাহ আল-মাইদাহ, ৫ : ১১২)

তখন ঈসা আলাইহিস সালাম বললেন –

“…. যদি তোমরা ঈমানদার হও তবে আল্লাহ’কে ভয় করো।” (সূরাহ আল-মাইদাহ, ৫ : ১১২)

এতে বুঝা যায়, ঈমানদার বান্দার পক্ষে এ ধরনের ফরমাইশ করে আল্লাহ’কে পরীক্ষা করা কিংবা তার কাছে অলৌকিক বিষয় দাবী করা একান্তই অনুচিত।

এমনিভাবে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে মুজিযাসমূহ আবু বকর, উমর ও উসমান (রাঃ) তলব করেননি, বরং আবু জাহল, আবু লাহাব, উতবা, শায়বা প্রমুখ কাফিররাই তলব করেছিলো। অন্যান্য নবী-রাসুলগণের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য।

আরো একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, কাফিররা জাহেরি মুজিযা তলব করতো তাদের শত্রুতা, হিংসা, দ্বেষ এবং অন্তরের হঠকারিতা ও গোঁয়ার্তুমির বশবর্তী হয়ে – সত্যানুসন্ধানী হয়ে নয়। এ কারণে তারা একের পর এক জাহেরী মুজিযা তলব করেই যাচ্ছিলো। পক্ষান্তরে যখনই তাদের দাবী অনুসারে কোন মুজিযা বাস্তবায়িত হতো তখন তারাই তাকে যাদু বলে আখ্যায়িত করে বসতো। বস্তুত এরূপ গোঁয়ার্তুমি ও কূপমণ্ডূকতায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা কখনো জাহেরী মুজিযা দেখে উপকৃত হতে পারে না বরং তারা নিজেদের অন্তরের কপটতার দরুন জাহেরী মুজিযাকে যাদু ইত্যাদি বলে আখ্যায়িত করে এবং নবুওয়াতের সত্যতার প্রমাণ হিসেবে তাকে মেনে নিতে অস্বীকার করে। মুসা আলাইহিস সালাম ফিরাউন ও তার অনুসারীদেরকে অনেক মুজিযা দেখিয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিটি মুজিযার ক্ষেত্রেই মুসা আলাইহিস সালাম’কে ফিরাউনের মুখে একই জবাব শুনতে হয়েছিলো – “তুমি মহাযাদুকর”, অথবা – “এটা তো প্রকাশ্য যাদু”, অথবা – “এই মুসা ও তার ভাই উভয়ে জাদুকর।” দেখুনঃ ৫ : ১১০ ; ৬ : ৭ ; ১০ : ৭৬ ; ১১ : ৭ ; ২৭ : ১৩ ; ৩৪ : ৪৩ ; ৩৭ : ১৫ ; ২০ : ৬৩ ; ৭ : ১১২।

আরো আশ্চর্যের বিষয় ছিল এই যে, মুসা আলাইহিস সালামের মুজিযা দেখে মিসরের সমস্ত যাদুকর সিজদায় পড়ে গিয়েছিলো আর তাদের প্রত্যেকে ঈমান এনে চির সৌভাগ্যমণ্ডিত হয়েছিলো। কিন্তু ফিরআউনের মুখে ছিল পূর্বের সেই একই কথা, অভিন্ন বুলি –

” …… সে তো তোমাদের (যাদুকর) প্রধান, সে তোমাদেরকে যাদু শিক্ষা দিয়েছে …..” (সূরাহ তো-হা, ২০ : ৭১)

শেষনবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ক্ষেত্রে ঠিক একই অবস্থা ঘটেছিলো। কাফির কুরাইশ সম্প্রদায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে মুজিযা তলব করেছিলো আর মুজিযার বিকাশ দেখার পরই তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যাদুকর বা কাহিনীকার বলে আখ্যায়িত করেছিলো। দেখুনঃ ৭৪ : ২৪ ; ৫২ : ২৯, ৩০ ; ৫৪ : ১-২ ; ৬৯ : ৪০, ৪৮।

উপরে উল্লিখিত আলোচনার দ্বারা একটি সংশয়ের অবসানও হয়ে গেলো যে, পবিত্র কুরআন ও হাদিসে লক্ষ্য করা যায় যে, মক্কায় কাফিররা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট বরাবর মুজিযা তলব করেছে, কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সেই দাবী অনুসারে মুজিযা দেখাননি কেন ?

বস্তুত তাদেরকে অনেক জাহেরী মুজিযা দেখানো হয়েছিলো, কিন্তু জাহেরী মুজিযা দিয়ে কাফিরদের মন কখনো শান্ত হয় না এবং এতে তারা কখনো হিদায়াত লাভ করতে পারে না। কারণ এই সমস্ত মুজিযা তলবের পিছনে তাদের অন্তরের কপটতা, হিংসা, দ্বেষ ও গোঁয়ার্তুমি কার্যকর থাকে। এই অবস্থায় তাদের প্রার্থিত মুজিযা সংঘটনে তাদের বিশেষ কোন ফায়দা হতো না, বরং এটা তাদের অন্তরের শঠতাকে আরো বৃদ্ধি করতো। আল্লাহ তাআলা বলেন –

“আর যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, এটি তাদের কলুষের সাথে আরো কলুষ যুক্ত করে …..” (সূরাহ আত-তাওবাহ, ৯ : ১২৫)

আরো দেখুনঃ ২ : ১০ ; ৭১ : ২৪, ২৮ ; ১৭ : ৮২ ; ৫  : ৬৪, ৬৮।

তাই পবিত্র কুরআনে জাহেরী মুজিযা তলবের কারণে কাফিরদেরকে ভৎসনা করা হয়েছে আর বাতেনী মুজিযার প্রতি তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছেঃ

“তারা বলে, সে তার প্রতিপালকের কাছ থেকে আমাদের কাছে কোন নিদর্শন আনে না কেন ? তাদের কাছে কি আসেনি সুস্পষ্ট প্রমাণ, যা আছে পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহে ?” (সূরাহ তো-হা, ২০ : ১৩৩)

“তারা বলে, তার প্রতিপালকের কাছ থেকে তার কাছে নিদর্শন প্রেরিত হয় না কেন ? বলুন, নিদর্শন আল্লাহ’র এখতিয়ারে, আমি তো একজন প্রকাশ্য সতর্ককারী মাত্র। এটি কি তাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, আমি আপনার কাছে কুরআন নাযিল করেছি, যা তাদের কাছে পাঠ করা হয় ? এতে অবশ্যই বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য অনুগ্রহ ও উপদেশ রয়েছে।” (সূরাহ আল-আনকাবুত, ২৯ : ৫০-৫১)

এ কারণেই পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে কাফিরদের জাহেরী মুজিযা তলবের প্রতিউত্তরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে কেবল এতোটুকু বলতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে – আমি তো কেবল একজন মানুষ ও পয়গাম্বর। ইরশাদ হয়েছেঃ

“এবং তারা বলে, আমরা কখনো আপনার প্রতি ঈমান আনবো না, যতক্ষণ না আপনি আমাদের জন্য ভূমি থেকে এক প্রস্রবণ উৎসারিত করবেন; অথবা আপনার খেজুরের বা আঙ্গুরের এক বাগান হবে, যার ফাঁকে-ফাঁকে আপনি অজস্র ধারায় প্রবাহিত করবেন নদী-নালা; অথবা আপনি যেমন বলে থাকেন, সে অনুযায়ী আকাশকে খণ্ড-বিখন্ড করে আমাদের উপর ফেলবেন, অথবা আল্লাহ ও ফেরেশতাগণকে আমাদের সামনে উপস্থিত করবেন ; অথবা আপনার একটি স্বর্ণ নির্মিত ঘর হবে অথবা আপনি আকাশে আরোহণ করবেন, কিন্তু আপনার আকাশ আরোহণে আমরা কখনো ঈমান আনবো না, যতক্ষণ আপনি আমাদের প্রতি কিতাব নাযিল না করবেন, যা আমরা পাঠ করবো, বলুন – পবিত্র মহান আমার প্রতিপালক, আমি তো হচ্ছি কেবল একজন মানুষ, একজন রাসুল।” (সূরাহ বানি ঈসরাঈল, ১৭ : ৯০-৯৩)

 

মুজিযা সম্পর্কে বিতর্ক

নবী-রাসুলগণকে আল্লাহ জাহেরী ও বাতেনী উভয় প্রকার মুজিযা প্রদান করেছেন। এটা প্রত্যেক নবীর বেলায়ই ঘটেছে। কিন্তু এই জাহেরী ও বাতেনী মুজিযার পার্থক্য এবং উপরে উল্লিখিত আয়াতসমূহের গুঢ়ার্থ অনুধাবনের ব্যর্থতার কারণে কোন কোন লোক মনে করে বসেছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাফিরদেরকে কোন জাহেরী মুজিযা দেখাননি। যদি তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জাহেরী মুজিযা দেখাতেন, তাহলে বারবার কেন তারা মুজিযা তলব করেছিলো ? এমনকি কোন কোন অবিবেচক ইসলামী পণ্ডিত এ কথাও বলেছেন – “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কুরআন ছাড়া অন্য কোন মুজিযা ছিল না !” এ কারণে বর্তমানে কালে নতুন বিতর্কের সূচনা হয়েছে যে, আসলে কুরআন ছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্য কোন মুজিযা ছিল কিনা ?

মিসরের কয়েকজন মুসলিম পণ্ডিত, যথা উস্তাদ মুহাম্মাদ ফারীদ ওয়াজদী, শায়খ মুহাম্মাদ আবদুহু, সায়্যিদ আবদুল আযীয জাবীশ, আল-মানার সাময়িকীর সম্পাদক সায়্যিদ রাশীদ রিদা এবং মিসরের আল-আযহার রেক্টর মুহাম্মাদ মুস্তাফা আল-মারাগী এবং প্রখ্যাত লেখক শায়খ মুহাম্মাদ হুসায়ন হায়কাল প্রমুখ আধুনিক মুসলিম পণ্ডিতদের অভিমত এই যে, “পবিত্র কুরআনের বাইরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্য কোন মুজিযা ছিল না।” [দৃষ্টব্যঃ (১) মুহাম্মাদ ফারীদ ওয়াজদী, আল-মাদীনা ওয়াল ইসলাম, মিসর, হিজরি ১৩৫৩ / খৃ. ১৯৩৩, পৃষ্ঠা ৭১-৭২; (২) মুহাম্মাদ রাশীদ রিদা, তাফসিরুল মানার, মিসর, হিজরি ১৩৭৩ / খৃ. ১৯৫৪; ১১খ. ; (৩) ঐ লেখক, আল- ওয়াহয়ুউল মুহাম্মাদী, মিসর, হিজরি ১৩৫৪ ; (৪) শায়খ মুহাম্মাদ আবদুহু, রিসালাতুত তাওহীদ, মিসর, হিজরি ১৩৬৫ ; (৫) মুস্তাফা আল-মারাগী, মুকাদ্দাম হায়াতে মুহাম্মাদ লিল-হায়কাল, মিসর, খৃ.১৯৭৪ ; (৬) সায়্যিদ আবদুল আযীয জাবিশ, দ্বীনুল ফিতরাতি ওয়াল-হুরারিয়্যাহ ; (৭) মুহাম্মাদ হুসায়ন হায়কাল, হায়াতে মুহাম্মাদ, মিসর, দারুল আআরিফ, খৃ. ১৯৭৪, ১২শ সংস্করণ, ভুমিকা]

ড. মুহাম্মাদ হুসায়ন হায়কাল তার কিতাব “হায়াতে মুহাম্মাদ” গ্রন্থের ভুমিকায় তাদের উক্ত অভিমতের সমর্থনে পবিত্র কুরআনের পূর্বোক্ত চারটি আয়াত (১৭ :৯০-৯৩) আর তার সাথে নিন্মোক্ত আয়াত প্রমাণ হিসেবে পেশ করেছেনঃ

“তারা আল্লাহ’র নামে কঠিন শপথ করে বলে যে, তাদের কাছে যদি কোন নিদর্শন আসতো, তবে অবশ্যই তারা এতে ঈমান আনতো; বলুন, নিদর্শন তো আল্লাহ’র এখতিয়ারভুক্ত, তাদের কাছে নিদর্শন আসলেও তারা যে ঈমান আনবে না এটা কিভাবে তোমাদের বোধগম্য করানো যাবে ?” (সূরাহ আল-আনআম, ৬ : ১০৯)

ড. হায়কাল আয়াত দুটো উপস্থাপনের পর লিখেছেনঃ বস্তুত পবিত্র কুরআন ও তার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ হাদিসসমূহ কুরআন ছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যান্য মুজিযার ব্যাপারে অনেকটা নীরব বলা চলে। এ ক্ষেত্রে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে, এমতাবস্থায় পূর্ববর্তীদের থেকে শুরু করে বর্তমান যুগের মুসলমানগণ পর্যন্ত সকলেই পবিত্র কুরআন ছাড়া অন্যান্য মুজিযার ব্যাপারে এতোটা সোচ্চার কেন ? এ প্রশ্নের একটাই উত্তর হতে পারে। তা এই যে, মুসলমানগণ পবিত্র কুরআনে পূর্ববর্তী নবী-রাসুলগণের বিভিন্ন মুজিযার ঘটনা ও কাহিনী দেখতে পেয়েছে। এতে তারা প্রভাবিত হয়ে পড়েছে। তারা মনে করেছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে জন্যও মুজিযা হওয়া অত্যাবশ্যক। তাদের ধারণায় জড়ো অলৌকিক ঘটনা ছাড়া বিশ্বাস-ই পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না। তারা অলৌকিক ঘটনাবলীর ব্যাপারে বর্ণনাগুলোকে নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য মনে করে বসেছে, অথচ এ সকল বর্ণনা যে পবিত্র কুরআন সমর্থিত না, এ দিকটির প্রতি তারা কোন প্রকার গুরুত্বারোপই করেননি। তারা ধারণা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুজিযার প্রাচুর্য তার রিসালাতের প্রতি মানুষের ঈমান ও বিশ্বাসকেই শক্তিশালী ও বৃদ্ধির কারণ হবে। অথচ পূর্ববর্তী নবী-রাসুলগণের সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাদৃশ্য ভিন্নধর্মী বিষয়কে একত্রিকরণ বৈ আর কিছু না। (হায়াতে মুহাম্মাদ, ভুমিকা)

“পবিত্র কুরআন ছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্য কোন মুজিযা ছিলো না” – এই দাবীর সমর্থনে ড. হায়কাল কুরআনের যে দুটো আয়াত উদ্ধৃত করেছেন, তা দিয়ে তার দাবী কোনভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয় না। কারণ, সকল নির্ভরযোগ্য তাফসীর ও হাদিসে উক্ত আয়াত দুটোর যে শানে নুযূল, প্রেক্ষাপট ও ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে, তাতে তার দাবীর সমর্থন নেই, বরং আয়াত দুটোর মর্ম এই যে, এতে মক্কার মুশরিকদের কূট-উদ্দেশ্য তুলে ধরা হয়েছে। “পবিত্র কুরআনের বাইরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আর কোন মুজিযা নেই” – এতে এমন উক্তি করা হয়নি। আল্লামা ইবনে কাসির তার “তাফসিরুল কুরআনিল আযীম” গ্রন্থে প্রথমোক্ত আয়াতটির পটভূমি বর্ণনা প্রসঙ্গে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু’র সূত্রে সহিহ হাদিস রিওয়ায়াত করেছেন যে, একদিন মক্কার মুশরিক সর্দারেরা বসে খোশগল্প করছিলো। তারা এক লোক দিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে ডেকে পাঠালো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে হাজির হলে তারা তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপরের আয়াতে উল্লিখিত প্রশ্নগুলো করলো। এ সমস্ত প্রশ্নের পিছনে তাদের কোন সদুদ্দেশ্য ছিল না। এমনকি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের দাবীগুলো বাস্তবায়িত করে দেখালেও তারা ঈমান আনতো না, বরং আরো হাজারো মুজিযা দাবী করে বসতো। আর তাদের দেখাদেখি অন্যরাও এই ধরণের দাবী করতে আরম্ভ করতো। ফলে আল্লাহ’র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে ইসলাম প্রচারের মহান ব্রতকে বাদ দিয়ে তাদের এই সমস্ত গোঁয়ার্তুমিমূলক প্রশ্নের উত্তরেও দাবী-দাওয়া পূরণের কাজ করেই বেড়াতে হতো। তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুশরিকদের এ সমস্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রশ্নের কোন গুরুত্ব দেননি। (তাফসীর ইবনে কাসির, ৩খ.)

পবিত্র কুরআনের উক্ত আয়াতটির পটভূমিও এমন একটি ঘটনা। মক্কার মুশরিকরা শপথ করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে বললো, আপনি আমাদের প্রত্যাশিত মুজিযার অংশবিশেষ বাস্তবায়িত করে দেখালে আমরা ঈমান আনবো। বস্তুত তাদের এই শপথ ছিল মিথ্যা, অসার। আল্লাহ তাদের এই মিথ্যা শপথের পর্দা উন্মোচনের লক্ষ্যে উক্ত আয়াতটি নাযিল করেন আর বলেন, একটি মুজিযা প্রকাশের পর আরেকটি, এরপর আরো একটি, এভাবে মুজিযার পর মুজিযা প্রকাশের মাধ্যমে কোন শুভ ফল হতে পারে না; বরং সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদীর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করার মতো একটি মুজিযাই যথেষ্ট। বারবার অলৌকিক ঘটনা প্রদর্শনের দাবী নিরর্থক বৈ কিছু না। (তাফসীর ইবন কাসির, ২খ.)

মোটকথা, উক্ত ভাষ্য দুটোতে এ কথা বুঝানো হয়নি যে, কুরআনের বাইরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন মুজিযা নেই, বরং তাতে এ কথা বুঝানো হয়েছে যে, সত্য প্রমানের জন্য বারবার জাহেরী মুজিযা তলব ও তা প্রদর্শনের মধ্যে কোন ফায়দা নেই। হঠকারী ও গোঁয়ার্তুমিমুক্ত অন্তর নিয়ে একটি মুজিযা দেখাই সত্য প্রমাণের জন্য যথেষ্ট।

পূর্বোল্লিখিত বক্তব্যের বিপরীতে ড. হায়কাল যুক্তি পেশ করেছেন যে, “কুরআনের বাইরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুজিযা আছে” মেনে নিলে পূর্ববর্তী নবী-রাসুলগণের সাথে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাদৃশ্য ভিন্নধর্মী বিষয়কে একত্রকরণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তার এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য না। কারণ, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকল নবী-রাসুলগণের নেতা এবং সর্বশেষ নবী ও রাসুল ছিলেন। কিন্তু তাই বলে অন্য নবী-রাসুলগণের সাথে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন সাদৃশ্য ও মিল থাকবে না, এমন না। যেমন আল্লাহ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে বলেছেনঃ

“মুহাম্মাদ একজন রাসুল মাত্র, তার পূর্বে বহু রাসুল গত হয়েছেন; সুতরাং তিনি যদি মারা যান বা নিহত হোন, তবে তোমরা কি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে ? ……” (সূরাহ আলি ইমরান, ৩ : ১৪৪)

অনুরূপ অসংখ্য আয়াতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের নানাবিধ অবস্থাকে পূর্ববর্তী নবী-রাসুলগণের অবস্থার সাথে তুলনা করা হয়েছে এবং তা থেকে উপদেশ ও দিক-নির্দেশনা গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে। (দ্রষ্টব্যঃ ৬ : ১০, ৩৩, ৩৪, ৪২)। উপরন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

“আমার আর অন্যান্য রাসুলগণের উদাহারন এরূপ, যেমন একটি সুরম্য অট্টালিকা নির্মিত হলো। বহু লোক সমবেত হয়ে এর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে লাগলো, তারা সকলেই বাহবা বলে প্রশংসা করতে লাগলো। কিন্তু এই সুরম্য অট্টালিকার এক কোণে একটি ইস্টকের স্থান শূন্য দেখে তারা বলতে লাগলেন – আহ, এই শূন্য স্থানটি যদি পূর্ণ হতো তবে কতোই না সুন্দর হতো।” এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “অনন্তর আমিই সেই (শূন্যস্থান পূর্ণকারী) ইষ্টক, আর আমিই সর্বশেষ নবী।” (বুখারী, ১খ. ; মুসলিম, ২খ.)

সুতরাং অন্যান্য নবী-রাসুলগণের জাহেরী ও জড়ো মুজিযা ছিল বলে অনুরূপ মুজিযা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থাকতে পারবে না, এটা কোন যুক্তিগ্রাহ্য কথা নয়।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র জীবনের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনায় অতীতে কিছু কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটেছে, এ কথা অস্বীকার করা যায় না। তবে এ কথাও স্বতঃসিদ্ধ যে, অতীতের বিভিন্ন যুগের মুহাদ্দিসীন ও হাদিস বিশেষজ্ঞগণ নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন-চরিত বিষয়ক বর্ণনারাজিকে সে সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত করার নিরলস চেষ্টা চালিয়েছেন আর এ ক্ষেত্রে তারা অভাবিত সাফল্য অর্জন করেছেন। তারা রিওয়ায়াতসমূহের শুদ্ধ-অশুদ্ধ পার্থক্যকরণে সক্ষম হয়েছেন। সুতরাং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের অলৌকিক ঘটনাবলী সম্পর্কিত বিশুদ্ধ হাদিস ও রিওয়ায়াতসমূহ গ্রহণ করতে এখন আর আপত্তি করার সঙ্গত কোন কারণ নেই।

কিন্তু ড. হায়কাল তার কিতাব “হায়াতে মুহাম্মাদ” এর ভুমিকায় এ সমস্ত হাদিস ও রিওয়ায়াতসমূহকে শুদ্ধ-অশুদ্ধ নির্বিশেষে এক দৃষ্টিতে দেখেছেন। তিনি লিখেছেন – “পবিত্র কুরআনই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একক মুজিযা।” এরপর তিনি লিখেছেন – “যদি রিসালাত প্রমাণের জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্য কোন মুজিযা থাকতো, তবে তা পবিত্র কুরআন উল্লেখ করা হলো না কেন ?” এ পর্যন্ত বলেই তিনি ক্ষান্ত হোননি, আরেকটু অগ্রসর হয়ে তিনি মুজিযাকে যুক্তি-বুদ্ধির নিরিখে বিচার করতে চেয়েছেন। তিনি বলেন – “আজও যদি কোন অমুসলিম সম্প্রদায় ইসলাম গ্রহণ করে এবং মুজিযার ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন ছাড়া অন্য কোন কিছু স্বীকার না করে, তাহলে এজন্য তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা যাবে না। এতে তাদের ধর্মবিশ্বাস অসম্পূর্ণ হবে না। কেননা, সে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি ঈমান এনেছে। তার এই অধিকার রয়েছে যে, সে পবিত্র কুরআনের আলোকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যান্য মুজিযা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিন্তা-গবেষণা করতে পারবে। এরপর যদি অকাট্য প্রমাণ দিয়ে কোন কিছু সাব্যস্ত হয়, তা বিনা দ্বিধায় মেনে নিবে।”

ড. হায়কালের এই অভিমতও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ যা অস্বাভাবিক ও যা যুক্তি-বুদ্ধির ঊর্ধ্বে, তা-ই তো মুজিযা। সুতরাং যুক্তি বুদ্ধির নিরিখে কিরূপে কোন নবী ও রাসুলের অলৌকিক কর্মকীর্তির বিশুদ্ধতা মূল্যায়ন করা যাবে ?

তিনি প্রশ্ন তুলেছেন যে, কুরআন ছাড়া অন্য কোন মুজিযা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের থাকলে তা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হলো না কেন ? অথচ কুরআনের সাধারণ পাঠক মাত্রই জানেন, কুরআনে মাত্র একটি দুটি না, বরং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একাধিক মুজিযার উল্লেখ রয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ এখানে কয়েকটির উল্লেখ করছি –

(১) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মিরাজে গমন তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনের একটি ঐতিহাসিক সুবিখ্যাত মুজিযা। পবিত্র কুরআনে মিরাজ সম্পর্কে পরিষ্কার আলোচনা হয়েছে। এমনকি কুরআনের একটি সূরার নামকরণ করা হয়েছে “ইসরা” তথা মিরাজ নামে। এই সূরাতুল ইসরা’র সূচনাই হয়েছে এভাবে –

“পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত – যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি যাতে আমি তাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই; নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।” (সূরাহ আল-ইসরা, ১৭ : ১)

(২) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতও ছিল তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনের একটি অলৌকিক ও অস্বাভাবিক ঘটনা। হিজরত মাত্র একটি মুজিযাই নয়, বরং এটি ছিল একাধিক মুজিযার ধারক ও সংঘটন স্থল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন পার্থিব সহায়-সম্বলহীন। অপরদিকে কুরাইশ কাফিররা ছিল অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত ধনে-জনে বলীয়ান। তারা তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হত্যার পরিকল্পনা করেছিলো। প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন করে দুর্ধর্ষ বীর খোলা তরবারি নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে হত্যা করার দৃঢ় উদ্দেশ্যে বের হয়ে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে চারদিকে অবস্থান করছিলো। আল্লাহ কাফিরদের কবল থেকে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অলৌকিকভাবে রক্ষা করলেন। পবিত্র কুরআনে সেই ভয়াল ষড়যন্ত্রের দৃশ্য এভাবে চিত্রিত হয়েছে শব্দের গাঁথুনিতে (যার অনুবাদ) –

“আর স্মরণ করুন, কাফিররা আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আপনাকে বন্দী করার জন্য, হত্যা করার জন্য অথবা নির্বাসিত করার জন্য, এবং তারা ষড়যন্ত্র করে আর আল্লাহ’ও কৌশল করেন; আর আল্লাহ’ই তো কৌশলীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।” (সূরাহ আল-আনফাল, ৮ : ৩০)

কুরআনের অপর একটি সূরায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের অলৌকিক ঘটনাবলী এভাবে বিবৃত হয়েছেঃ

“যদি তোমরা তাকে সাহায্য না করো তবে স্মরণ করো, আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছিলেন যখন কাফিররা তাকে বহিস্কার করেছিলো এবং সে ছিল দুইজনের একজন, যখন তারা উভয়ে গুহার মধ্যে ছিল, সে তখন তার সঙ্গীকে বলেছিলো – বিষণ্ণ হয়ো না, আল্লাহ আছেন আমাদের সাথে; এরপর আল্লাহ তার উপর প্রশান্তি বর্ষণ করেন এবং তাকে শক্তিশালী করেন এমন এক সৈন্যবাহিনী দিয়ে, যা তোমরা দেখোনি; তিনি কাফিরদের বাক্য হেয় করেন আর আল্লাহ’র বাক্যই সর্বোপরি, আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।” (সূরাহ আত-তাওবাহ, ৯ : ৪০)

(৩) অনুরূপ বদর যুদ্ধে আল্লাহ মুসলমানগণকে অলৌকিকভাবে বিজয় দান করেছিলেন, বদরে তিনি তার ফেরেশতা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। এটা ছাড়া আরো অলৌকিক ঘটনা বদরে সংঘটিত হয়েছে, যার প্রতিটির বর্ণনা কুরআনে রয়েছে। ফেরেশতা বাহিনীর মাধ্যমে যুদ্ধের ফলাফল মুসলমানদের অনুকূলে আনয়নের মুজিযা এভাবে উপস্থাপিত হয়েছেঃ

“স্মরণ করো, যখন তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিলে, তিনি তা কবুল করেছিলেন আর বলেছিলেন, আমি তোমাদেরকে সাহায্য করবো এক হাজার ফেরেশতা দিয়ে যারা একের পর এক আসবে। আল্লাহ এটা করেন কেবল শুভ সংবাদ দেওয়ার জন্য এবং এই উদ্দেশ্যে যাতে তোমাদের চিত্ত প্রশান্তি লাভ করে, আর সাহায্য তো শুধু আল্লাহ’র কাছ থেকেই আসে; আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (সূরাহ আল-আনফাল, ৮ : ৯-১০)

(৪) এমনিভাবে বদর প্রান্তরে মুসলমানদের কল্যাণে অসময়ে বৃষ্টি বর্ষণের মুজিযা কুরআনে বিবৃত হয়েছেঃ

“… এবং আকাশ থেকে তোমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করেন তা দিয়ে তোমাদের পবিত্র করার জন্য, তোমাদের থেকে শয়তানের কুমন্ত্রণা অপসারণের জন্য, তোমাদের হৃদয় দৃঢ় করার জন্য আর তোমাদের স্থির রাখার জন্য।” (সূরাহ আল-আনফাল, ৮ : ১১)

(৫) অনুরূপ বদর প্রান্তরে কাফিরদের চোখে মুসলমানদের সংখ্যা কম দেখানো হয়েছে যাতে তারা অধিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। অপর দিকে মুসলমানদের চোখে কাফিরদের কম দেখানো হয়েছে যাতে মুসলমানগণ ঘাবড়িয়ে না যায়। এটি ছিল একটি মুজিযা ও অসাধারণ ব্যাপার। কুরআনে উদ্ধৃত হয়েছেঃ

“দুটি দলের পরস্পর সম্মুখীন হওয়ার মধ্যে তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে – একদল আল্লাহ’র পথে লড়াই করছিলো, অন্যদল কাফির ছিলো; তারা তাদেরকে চোখের দেখায় দ্বিগুণ দেখছিলো; আল্লাহ যাকে ইচ্ছে নিজ সাহায্য দ্বারা শক্তিশালী করেন; নিশ্চয়ই এতে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লোকের জন্য শিক্ষা রয়েছে।” (সূরাহ আলি ইমরান, ৩ : ১৩)

বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন মাওলানা তফাজ্জল হুসাইন রচিত হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) : মুজিযার স্বরূপ ও মুজিযা। দৃষ্টান্তস্বরূপ মাত্র কয়েকটি মুজিযা এখানে উল্লেখ করা হলো। এগুলো ছাড়াও আরো বহু মুজিযার ঘটনা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং ড. হায়কালের এই দাবী যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুজিযা বলতে শুধু পবিত্র কুরআনকে বুঝায় এবং এটি ছাড়া তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন মুজিযা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হয়নি – এই দাবী সম্পূর্ণ মনগড়া ও ভিত্তিহীন।

ড. হায়কালের মতে, হাদিস ও সিরাত গ্রন্থসমূহে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে সংঘটিত যে সমস্ত অসাধারণ ও অলৌকিক ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়, তা হয় মনগড়া, বানোয়াট কিংবা সমালোচনার ঊর্ধ্বে না। সুতরাং তার নানারূপ ব্যাখ্যার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। এরপর তিনি কুরআন ছাড়া অন্যান্য মুজিযাসমূহের অসারতা ও অবাস্তবতা প্রমাণের উদ্দেশ্যে দুটো কাহিনী উপস্থাপন করেছেন এবং তার অসারতা প্রমাণের জন্য যুক্তিতর্কের অবতারণা করেছেন। কাহিনী দুটো নিন্মরূপঃ

(১) ড. হায়কাল লিখেছেন, সিরাত বিষয়ক সকল গ্রন্থেই অভিন্ন মত প্রকাশ করা হয়েছে যে, মিরাজের পূর্বে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তারা একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখে শুনতে পেলেন যে, একই রাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় ভ্রমণ করানো হয়েছে এবং সেখানের পবিত্র স্থানগুলো পরিদর্শন করানো হয়েছে। এ কথা শুনার সাথে সাথে একদল মুসলমান তা অবিশ্বাস করে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করলো। (হায়াতে মুহাম্মাদ, ভূমিকা)

(২) ড. হায়কাল লিখেছেন, সুরাকা ইবন মালিক ইবন জুশুমের ঘটনাও এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। হিজরতের সময় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনার উদ্দেশ্যে মক্কা ত্যাগ করেন। তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবিত কিংবা মৃত ধরিয়ে দেওয়ার জন্য মক্কাবাসী কাফিররা পুরস্কার ঘোষণা করে। সুরাকা পুরস্কারের লোভে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে ধরার জন্য তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পিছু ধাওয়া করে। সে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর্যন্ত পৌছতে সক্ষম হয়। এমনকি কোন কোন জীবন-চরিতকার লিখেছেন, সে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে পৌছলে অলৌকিকভাবে তার ঘোড়ার ক্ষুর মাটিতে দেবে যায়। (হায়াতে মুহাম্মাদ, ভূমিকা)

ড. হায়কালের এই দুটো ঘটনা বর্ণনার উদ্দেশ্য এই যে, নবী- রাসুলগণের মুজিযা তাদের দাবীর সত্যতা প্রতিষ্ঠা ও তাদের প্রতি ঈমান আরো সুদৃঢ়করণের জন্য সহায়কস্বরূপ। সে হিসেবে কোন নবী-রাসুল থেকে কোন মুজিযা প্রকাশ পাওয়া তার প্রতি অবিশ্বাসীদের ঈমান আনয়নের সহায়ক হবে, আর বিশ্বাসীদের ঈমানকে আরো সুদৃঢ় করবে। এটিই যুক্তির চাহিদা। অথচ মিরাজের ঘটনায় কোন কাফিরের ঈমান আনা তো দূরের কথা, স্বয়ং ইতিপূর্বে যারা ঈমানদার ছিলো তাদের একটি দল পর্যন্ত এই ঘটনা শুনে মুরতাদ হয়ে গেলো। এটি তো এ কথাই প্রমাণ করে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে আল-কুরআন ভিন্ন অন্য কোন মুজিযা ছিল না।

অনুরূপ, সুরাকার ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন যে, এই মুজিযা দেখেও সুরাকা ঈমান আনলো না কেন ? ফিরআউনের যাদুকররা তো মুসা আলাইহিস সালামের মুজিযা দেখে ঈমান এনেছিলো।

মুজিযার সত্যতা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে ড. হায়কালের গৃহীত মূলনীতি দেখে বড়ই আশ্চর্যবোধ হয়। তিনি কোথা থেকে এই মূলনীতি আবিস্কার করলেন যে, কোন নবীর মুজিযা দেখে তার উম্মত ঈমান না আনলে উক্ত মুজিযা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে ? স্বয়ং ড. হায়কালের দাবী মতে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একমাত্র মুজিযা পবিত্র কুরআন শুনে তার সকল শ্রোতাই কি ঈমান এনেছিলো ? উত্তর “না” হলে পবিত্র কুরআন কি অসত্য হয়ে যাবে ? বস্তুত তিনি তার ভিত্তিহীন মনগড়া একটি যুক্তি দিয়ে দুটো সুপ্রতিষ্ঠিত মুজিযা অস্বীকার করার প্রয়াস পেয়েছেন, যার একটি (মিরাজ) স্বয়ং কুরআনে বর্ণিত হয়েছে এবং অপরটি (সুরাকার ঘটনা) বুখারী ও মুসলিমসহ হাদিস ও সিরাতের সকল বিশুদ্ধ গ্রন্থে সহিহ সনদে সংরক্ষিত আছে। (দ্রষ্টব্যঃ বুখারী, ১ম খণ্ড ; মুসলিম, ২য় খণ্ড)

ড. হায়কাল আরো একটি যুক্তি পেশ করেছেন যে, অন্যান্য নবী-রাসুলগণের মুজিযা দেখে বিরুদ্ধবাদীদের  ঈমান আনার ঘটনা পবিত্র কুরআন ও ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন মুজিযা দেখে কোন মুশরিক ঈমান এনেছে এমন বর্ণনা ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়নি। এটা প্রমাণ করে যে, কুরআন ছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন মুজিযা ছিল না। (হায়াতে মুহাম্মাদ, ভূমিকা)

ড. হায়কালের এই যুক্তি তথ্যনির্ভর না। কারণ হাদিস ও সিরাতের গ্রন্থসমূহে এ জাতীয় একাধিক ঘটনা সহিহ সনদ দ্বারা সংরক্ষিত হয়ে আসছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ আমরা তার কয়েকটি ঘটনা এখানে উদ্ধৃত করছিঃ

(১) এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাজির হয়ে বললো, আমি ঐ পর্যন্ত আপনাকে সত্য নবী বলে স্বীকার করবো না, যতক্ষণ না এই খেজুর বৃক্ষের কাঁদিসমূহ আপনার কাছে এসে আপনার রিসালাতের সত্যতা সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয়। আল্লাহ’র কৃপায় তা-ই ঘটলো। যখন সে এই ঘটনা নিজ চোখে দেখলো, তখন ইসলাম গ্রহণ করলো। (তিরমিযি)

(২) একবার এক সফরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে এক বেদুঈনের সাক্ষাৎ হলো। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লোকটিকে ইসলামের প্রতি আহবান জানালেন। লোকটি বললো, আপনার সত্যতার সাক্ষ্য কে দিচ্ছে ? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সামনের এই বৃক্ষটি। এই কথা বলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বৃক্ষটিকে কাছে ডাকলেন। তৎক্ষণাৎ বৃক্ষটি তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সামনে হাজির হলো আর তার মধ্য থেকে তিনবার কালেমা তায়্যিবার ধ্বনি উচ্চারিত হলো। এই দৃশ্য দেখে লোকটি তৎক্ষণাৎ ইসলামে দাখিল হয়ে গেলো। (সিরাতুন্নবী, ৪খ.)

(৩) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতকালে উম্মে মাবাদ ও আবু মাবাদ নামক দুইজন মরুবাসীর ইসলাম গ্রহণের কথা সুবিখ্যাত। তারা ছিলেন খুজাআ গোত্রের লোক। মদিনার পথে একটি ঝুপড়ীতে তারা বাস করতো আর পথিক-মুসাফিরদের সেবা ও মেহমানদারী করতো। মেষ পালনই ছিল তাদের একমাত্র জীবিকা নির্বাহের উপায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু উম্মে মাবাদের ঝুপড়ীর পার্শ্ব অতিক্রম করে যাচ্ছিলেন। তারা কিছু পাথেয় খরীদ করার জন্য উম্মে মাবাদের ঝুপড়ীতে আসলেন। কিন্তু খরীদ করার মতো কিছুই তার কাছে পাওয়া গেলো না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখলেন, উম্মে মাবাদের ঝুপড়ীর এক কোণে একটি ছাগী দাঁড়িয়ে আছে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, এই ছাগীটি দুধ দেয় কি ? উম্মে মাবাদ বললেন, সে তো হাঁটতেই পারে না, এতো দুর্বল ছাগী আবার দুধ দেয় ? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আপনি অনুমতি দিলে আমি দোহন করে দেখতে পারি। উম্মে মাবাদ বললেন, আচ্ছা, আপনি দোহন করুন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিসমিল্লাহ বলে তার দুধ দোহন করতে লাগলেন। দেখা গেলো, দুধ বের হয়ে আসছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথীগণ, উম্মে মাবাদ ও তার ঝুপড়ীর লোকজন সকলেই তৃপ্তি সহকারে পেট ভরে দুধ পান করলেন। তারপর আরো কিছু দুধ উম্মে মাবাদের কাছে অবশিষ্ট রয়ে গেলো।

দুধ পান করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথীসহ মদিনা অভিমুখে রওয়ানা হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরেই আবু মাবাদ মরুভূমিতে মেষ চারণ করে ঝুপড়ীতে ফিরে আসলেন। আবু মাবাদ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শুনে বললেন, আল্লাহ শপথ, ইনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মনে হয় কুরাইশ গোত্রের সেই লোকটি, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কথা অনেক শুনেছি, আমাদের সুযোগ হলে আমরা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দরবারে উপস্থিত হবো। ইবন কাসির রিওয়ায়াত করেছেন যে, এ ঘটনার পর উম্মে মাবাদ ও আবু মাবাদ উভয়ই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। (ইবন হিশাম, ১খ. ; আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ৩খ.)

কিছু আধুনিক সিরাতকার উম্মে মাবাদের হাদিসটিকে সনদের দিক থেকে দুর্বল আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু মুহাক্কিক আলিমগণ হাদিসটির সনদ সম্বন্ধে তথ্য তালাশের পর হাদিসটিকে সহিহ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাদের অনুসন্ধান মতে এ হাদিসটি একাধিক সাহাবী থেকে একাধিক সনদে বর্ণিত হয়েছে, যথা –

(১) উম্মে মাবাদের সনদে ইবনুস সাকান, আল ইসাবায়। (দ্রষ্টব্যঃ ইসাবা, বাবুল আসমা ওয়াল কুনা)

(২) আবু মাবাদের সনদে ইমাম বুখারী তার তারিখ গ্রন্থে। (দ্রষ্টব্যঃ তাবাআত ইবন সাদ, ১খ.)

(৩) হুবায়শ ইবন খালিদের সনদে আল্লাম বাগাবী, ইবন শাহীন, ইবনুস সাকান ও ইমাম তাবারানী প্রমুখ মুহাদ্দিস নিজ নিজ গ্রন্থে। (দ্রষ্টব্যঃ তাহযিবুল কামাল, ১খ.)

(৪) আবু সালিত বদরীর সনদে হাদিসটি উয়ুনুল আসার গ্রন্থে বর্ণিত আছে। (দ্রষ্টব্যঃ সিরাতে মুস্তফা, ১খ.)

(৫) হিশামের সনদে মুসতাদরাকে হাকেম গ্রন্থে। হাকেম হাদিসটি রিওয়ায়াত করার পর মন্তব্য করেছেন – “এই হাদিসটি সনদ সহিহ”। (মুসতাদরাক, ৩খ.)

উপরন্তু এ ঘটনাটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের সাথী আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকেও সহিহ সনদে বর্ণিত হয়েছে। (দ্রষ্টব্যঃ দালায়েল লিল বায়হাকী, মুসতাদরাক লিল হাকেম ও আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া লি ইবন কাসির, ৩খ.) ইবন কাসির বলেন, “তার সনদ হাসান-নির্ভরযোগ্য।”

অতএব উম্মে মাবাদের বর্ণিত এই মুজিযার ঘটনাটি সম্বন্ধে কোন প্রকার সন্দেহ-সংশয় পোষণ করার কোনই যুক্তিসংগত কারণ নেই।

ড. হায়কালের বক্তব্যের অসারতা প্রমাণের জন্য সূরাহ আল-কামারের প্রথম দুই আয়াতই যথেষ্ট। ইরশাদ হয়েছেঃ

“কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে, আর চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে। এরা কোন নিদর্শন দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয় আর বলে – এটা তো চিরাচরিত যাদু।” (সূরাহ আল-কামার, ৫৪ : ১-২)

ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়ে চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়েছিলো, এক খণ্ড পাহাড়ের উপরের দিকে আর অপর এক খণ্ড পাহাড়ের নিচের দিকে ছিলো। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন – তোমরা সাক্ষী থাকো। (বুখারী, কিতাবুত তাফসীর)

 

আধুনিক মুসলিম পণ্ডিতদের এরূপ অভিমতের কারণ

জড়বাদী, বস্তু পূজারী ইউরোপীয় লেখকদের মধ্যে একটি প্রবণতা বিশেষভাবে দেখা যায় যে, তারা নবী-রাসুলগণের জীবদ্দশায় সংঘটিত যথার্থ তথ্য-প্রমাণে সুপ্রতিষ্ঠিত অলৌকিক (মুজিযা) ঘটনাবলী অস্বীকার করে থাকেন অথবা তারা নিজেদের সীমাবদ্ধ মানবীয় বিচার-বুদ্ধি ও যুক্তি দ্বারা তা বিকৃত করার অপচেষ্টা চালিয়ে থাকেন। তাদের এই সংকীর্ণ মানসিকতা সম্বন্ধে এটাই যথার্থ বক্তব্য হবে যে, যারা আধ্যাত্মিক জগতের খোঁজ জানে না, যাদের জ্ঞানের দৌড় বস্তুতান্ত্রিক জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, যাদের অন্তর ও মস্তিষ্ক জড় জগতের মধ্যে সীমাবদ্ধ – তাদের চোখে এ সমস্ত অলৌকিক (মুজিযা) ঘটনাবলী এভাবে প্রতিভাত হওয়াই স্বাভাবিক।

যারা নিজেদের রাসুল ঈসা আলাইহি সালামের অলৌকিক জন্মের কথা অস্বীকার করতে পেরেছে, তারা যে অন্যান্য নবী-রাসুলের, বিশেষ করে শেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে সংঘটিত অলৌকিক (মুজিযা) ঘটনাবলী অস্বীকার করবে, এতে বিস্মিত হওয়ার কি আছে ? তবে বিস্ময় লাগে আমাদের কিছু মুসলিম পণ্ডিতের জ্ঞান-বুদ্ধি ও যুক্তি-বিবেচনার উপর। কারণ তারা আল্লাহ’র জড়-ঊর্ধ্ব মহান কুদরত ও অসাধারণ ক্ষমতায় বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও সহিহ সনদ দিয়ে প্রমাণিত মুজিযাসমূহকে নিজেদের প্রসার যুক্তি ও সংকীর্ণ মেধা বুদ্ধি দিয়ে অস্বীকার করতে কিংবা তার অপব্যাখ্যা সন্ধানে উদ্যত হয়েছেন। তারা যে নিরপেক্ষ, সুস্থ যুক্তি ও বিবেক দিয়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাননি, বরং ইউরোপীয় জড়বাদী লেখকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন – তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ মিলে তাদেরই অন্যতম লেখক বন্ধু মিসরের ড. হুসাইন হায়কালের এই বক্তব্য থেকে।

তিনি তার গ্রন্থ “হায়াতে মুহাম্মাদ” এর ভুমিকায় মুজিযা প্রসঙ্গে লিখেছেন যে, খুব সম্ভব সে কালের ইসলামী চিন্তাবিদ ও লেখকগণ যুগের প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সংশ্লিষ্ট পবিত্র কুরআন বহির্ভূত অলৌকিক ঘটনাবলী তাদের গ্রন্থরাজিতে সংকলন করেছিলেন। বলা চলে, যুগের প্রয়োজনে এই ব্যাপারে তারা নিরুপায় ছিলেন। পরবর্তী যুগের লেখক ও চিন্তাবিদগণও এ ব্যাপারে তাদের পূর্ববর্তীদের অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছেন। তারা মনে করেছেন যে, এ সমস্ত অলৌকিক ঘটনার মাধ্যমে মুসলমানদের ঈমান সুদৃঢ় হবে। এমনকি এ সমস্ত ঘটনার পুনরাবৃত্তি করাও তাদের ধারণায় উপকার বৈ ক্ষতি ছিল না। তারা যদি এ ধরনের সুধারণা পোষণ না করতেন, তাহলে অবশ্যই তারা এ সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকতেন। তারা বর্তমানে জীবিত থাকলে দেখতে পেতেন, ইসলামের শত্রুরা এ সমস্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইসলাম সম্পর্কে জঘন্য সমালোচনা করেছে। এ পরিণতি দেখতে পেলে পবিত্র কুরআন বহির্ভূত অলৌকিক ঘটনাবলী কখনো তারা নিজেদের গ্রন্থগুলোতে সংকলন করতেন না। (হায়াতে মুহাম্মাদ, ভূমিকা, মুজিযা প্রসঙ্গে)

 

মুজিযা নবুওয়াতের প্রমাণ না নিদর্শন ?

“মুজিযা নবুওয়াতের প্রমাণ না নিদর্শন” – বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌছতে প্রাচীন মুসলিম মনীষীদের মধ্যে যেমন মতবিরোধ হয়েছে, বর্তমানকালেও তাতে প্রচণ্ড মতভেদ বহাল রয়েছে। অতীত ও প্রাচীন মুসলিম মনীষীদের মধ্যে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আশাইরা আকিদা বিশেষজ্ঞ আলীমদের অভিমত এই যে, মুজিযা নবুওয়াত ও রিসালাতের হুজ্জত বা প্রমাণস্বরূপ। পক্ষান্তরে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত বহির্ভূত মুতাজিলা সম্প্রদায়ভুক্ত চিন্তাবিদগণের অভিমত এই যে, মুজিযা নবুওয়াতের হুজ্জত বা প্রমাণ নয়, তবে তা নবুওয়াতের আলামত যে নিদর্শন মাত্র। (সিরাতুন্নবী, ৪খ.)

বর্তমান কালে মিসরীয় ইসলামী চিন্তাবিদ ও লেখকগণও এই অভিমত পোষণ করে থাকেন, এর বিপরীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ আলিম, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও ইসলামী বিশেষজ্ঞ মনীষীদের সর্বসম্মত অভিমত এই যে, মুজিযা নবুওয়াত ও রিসালাতের দাবীর সত্যতার প্রকৃষ্ট প্রমাণ, তা নিছক আলামত বা নিদর্শনের পর্যায়ের নয়। (দ্র. মানহাজুল মাদরাসাতিল আকলিয়া আল হাদিসাহ ফিত তাফসীর, ড. ফাহদ বিন আবদুর রহমান, বৈরুত, মুআসসাসতুর রিসালাহ, ১৪১৪ হিজরি, ২খ.)

 

যুক্তি ভিত্তিক প্রমাণ

মুতাযিলাদের দাবীর পক্ষে যুক্তি এই যে, তর্কশাস্ত্রের বিধানানুসারে দাবী ও দলীলের মধ্যে পারস্পরিক যোগসূত্র থাকা অপরিহার্য। কিন্তু মুজিযা ও নবুওয়াতের মধ্যে কোন প্রকার যোগসূত্র লক্ষ্য করা যায় না। যেমন, কোন ব্যক্তি যখন নবুওয়াতের দাবী করেন তখন তার উদ্দেশ্য হয়, তিনি আল্লাহ’র পক্ষ থেকে মানব জাতির আকিদা ও বিশ্বাস, আমল ও কার্যক্রম এবং আখলাক ও চরিত্র সংশোধনের জন্য প্রেরিত হয়েছেন। কিন্তু যখন তার কাছে এই দাবীর সত্যতা নিরূপণের জন্য দলীল প্রমাণ তলব করা হয়, তখন তিনি বিশুদ্ধ কুয়াকে পানি দিয়ে পরিপূর্ণ করে দেন কিংবা চাঁদকে দুই টুকরো করে দেখান অথবা তার লাঠি সাপে পরিণত হয়ে যায়। এ সমস্ত ঘটনা যদিও নেহায়েত আশ্চর্যজনক ও অভাবিতপূর্ব, কিন্তু এই সমস্ত দলীল-প্রমাণের সাথে দাবীর কোন কোন যোগসূত্র আছে কি ?

আশাইরা মনীষীগণ মুতাযিলাদের এই তর্ক-যুক্তির উত্তরে বলেন, নবুওয়াত হচ্ছে ইলম ও আমলের সমন্বিত রূপ। যে ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবী করেন ও তার সম্পর্কে এ কথা স্বীকার করে নেওয়া হয় যে, তিনি এই ইলম ও আমল সম্বন্ধে পরিপূর্ণ দক্ষতার অধিকারী এবং তার এই পরিপূর্ণতার বিকাশকল্পে তার কাছে মুজিযা তলব করা হয়। নবীগণের মুজিযা যদিও বিভিন্ন শ্রেণীর হয়ে থাকে, তবুও এগুলোকে শুধু দুই শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা যায়। যেমন, অদৃশ্য জগতের সংবাদ প্রদান করা এবং সৃষ্টি জগতের বস্তুনিচয়ের উপর স্বীয় কর্তৃত্ব বজায় রাখা। এই দুই শ্রেণীর কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন অংশের সাথে এবং নবুওয়াতের বিভিন্ন অংশের সাথে রয়েছে এক নিবিড় বন্ধন ও একাত্মতা। অদৃশ্য জগতের সংবাদ প্রদানের মাধ্যমে নবী-রাসুলগণের জ্ঞান ও মনীষার পরিপূর্ণতা বিকশিত হয়ে উঠে। অপরদিকে সৃষ্টি জগতের বস্তুনিচয়ের উপর কর্তৃত্ব নিষ্পন্ন করার দ্বারা তার ব্যবহারিক শক্তির বিকাশ সাধিত হয়।

অপর একটি যোগসূত্র হচ্ছে, মুজিযা হলো সহজাত স্বভাবের অতীত কোন স্বভাবের নাম। তবে এ ক্ষেত্রে এটি নিয়ে কোন মতবিরোধ নেই যে, বস্তুনিচয় তার গুণাবলী আর তার কারণসমূহ কেবল আল্লাহ’র নির্দেশ ও হুকুম দ্বারা আত্মপ্রকাশ করে। এখন যদি কোন শক্তি এসব বৈশিষ্ট্য ও কারণসমূহকে স্বীয় মুজিযার দ্বারা নিশ্চিহ্ন  কিংবা ভেঙ্গে-চুরে একাকার করে দিতে সক্ষম হোন, তাহলে তিনি বস্তুত এ কথার যথার্থতাই তুলে ধরলেন যে, যে মহানুভব ও সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তির অধিকারী সত্তা এ সমস্ত কারণ ও উপাদান সৃষ্টি করেছেন, কেবল তিনিই সেগুলোকে ধ্বংস কিংবা অকেজো করে দিতে পারেন। এই ভাঙ্গা-গড়ার অবিকল ধারা যেহেতু তার (নবীর) মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, সেহেতু এটা প্রমাণ করে যে, ইনিই সেই সত্তার প্রতিনিধি।

এর দৃষ্টান্ত এরূপ যে, একজন বাদশাহ স্বীয় প্রজাদের কাছে প্রয়োজনের তাকিদে দূত প্রেরণ করেন। প্রজাগণ জিজ্ঞাসা করলো, এ কথার প্রমাণ কি যে, আপনি মহান বাদশাহর একজন বার্তাবাহক প্রতিনিধি ? তখন সে তার প্রতিউত্তরে বাদশাহর সীলমোহর আর অঙ্গুরী পেশ করতে বাধ্য হয়; যদিও প্রকাশ্যভাবে দূতের পয়গাম্বরীসুলভ দাবীর সাথে সীলমোহর আর অঙ্গুরীয়ের সরাসরি কোন যোগসূত্র নেই, কিন্তু তবুও এর মধ্যে সম্পর্ক এভাবে প্রতিপন্ন হয় যে, সীলমোহর আর অঙ্গুরীয় বাদশারই নিদর্শন বটে, যা একজন সাধারণ মানুষের হাতে কখনো আসতে পারে না। সুতরাং এতে সুস্পষ্ট প্রমাণ হয় যে, এই দূতকে বাদশাহ সরাসরি তার একান্ত ব্যক্তিগত নিদর্শন প্রদান করেই প্রেরণ করেছেন।

 

মুজিযা নবুওয়াতের প্রমাণ হওয়ার অনুকূলে কুরআন-হাদিসের দলীল

(১) আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগের মুশরিক ও পৌত্তলিকদের নিন্দা, তিরস্কার ও ভৎসনা করেছেন এবং এই মর্মে তাদের বর্ণনা দিয়েছেন যে, মুশরিকরা আল্লাহ’র আয়াত ও মুজিযায় বিশ্বাসী না। যদি মুজিযা নবুওয়াতের প্রমাণই না হতো, তাহলে মুজিযা দেখার পর তাতে ঈমান না আনলে তারা ভৎসনা ও নিন্দার যোগ্য হবে কেন ? অথচ দেখুন, নিচের আয়াতসমূহে মুজিযা অস্বীকার করার কারণে মুশরিকদেরকে কীরূপ ভৎসনা করা হয়েছে –

“তাদের প্রতিপালকের নিদর্শনাবলীর এমন কোন নিদর্শন তাদের কাছে উপস্থিত হয় না, যা থেকে তারা মুখ না ফিরায়। সত্য যখন তাদের কাছে এসেছে, তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছে; যা নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতো, তার যথার্থ বিবরণ অচিরেই তাদের কাছে পৌঁছবে।” (সূরাহ আল-আনআম, ৬ : ৪-৫)

“তাদের মধ্যে কিছুলোক তোমার দিকে কান পেতে রাখে, কিন্তু আমি তাদের অন্তরের উপর আবরণ দিয়েছি যেন তারা তা উপলব্ধি করতে না পারে, আমি তাদেরকে বধির করেছি এবং তারা সমস্ত নিদর্শন দেখলেও তাতে ঈমান আনবে না, এমনকি তারা যখন তোমার কাছে উপস্থিত হয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়, তখন কাফিররা বলে, এটা তো সেকালের উপকথা ছাড়া কিছুই না। তারা অন্যকেও তা শুনতে বিরত রাখে আর নিজেরাও তা থেকে দূরে থাকে, আর তারা নিজেরাই তো শুধু নিজেদেরকে ধ্বংস করে, অথচ তারা উপলব্ধি করে না। তুমি যদি দেখতে পেতে যখন তাদেরকে আগুনের পার্শ্বে দাঁড় করানো হবে আর তারা বলবে, হায়! যদি আমাদের প্রত্যাবর্তন ঘটতো তবে আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিদর্শনসমূহকে অস্বীকার করতাম না এবং আমরা মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।” (সূরাহ আল-আনআম, ৬ : ২৫-২৭)

মুজিযা যদি হুজ্জত বা প্রমাণই না হয়, তাহলে কিসের ভিত্তিতে উপরে উল্লিখিত আয়াতসমূহে মুজিযা অস্বীকারকারীদেরকে এরূপ তিরস্কার করা হলো ?

(২) আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেনঃ

“পূর্ববর্তীগণ কর্তৃক নিদর্শন অস্বীকার করাই আমাকে নিদর্শন প্রেরণ করা থেকে বিরত রাখে, আমি শিক্ষাপ্রদ নিদর্শনস্বরূপ সামুদ জাতিকে উস্ট্র দিয়েছিলাম, এরপর তারা তার প্রতি জুলুম করেছিলো, আমি ভীতি প্রদর্শনের জন্যই নিদর্শন প্রেরণ করি।” (সূরাহ আল-ইসরা, ১৭ : ৫৯)

এ আয়াতের সারমর্ম এই যে, আল্লাহ দয়াপরবশ হয়ে মানুষের প্রতি মুজিযা প্রেরণ করেন না। কেননা, মুজিযা প্রকাশের পর মানুষ যদি তা অস্বীকার করে তাহলে তারা আযাবের যোগ্য হয়ে পড়বে। যেমন, অতীতের উম্মতসমূহের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে। সুতরাং এটাই এ কথার প্রমাণ বহন করে যে, মুজিযা নবুওয়াতের হুজ্জত বা প্রমাণ, যার প্রকাশের পর আর কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই। এর পরেও কেউ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব করলে সে শাস্তিযোগ্য হয়ে যাবে। সুতরাং মুজিযা হুজ্জত না হলে তা অস্বীকার করার প্রেক্ষিতে আযাব অবধারিত হয় কিভাবে ?

(৩) আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেনঃ

“স্মরণ করো, হাওয়ারীগণ বলেছিলো, হে মরিয়ম-পুত্র ঈসা, আপনার প্রতিপালক কি আমাদের জন্য আসমান থেকে খাদ্য পরিপূর্ণ খাঞ্চা প্রেরণ করতে সক্ষম ? সে বলেছিলো, তোমরা আল্লাহ’কে ভয় করো, যদি তোমরা মুমিন হও। তারা বলেছিলো, আমরা চাই যে, তা থেকে আমরা কিছু খাবো আর আমাদের চিত্ত প্রশান্তি লাভ করবে, আর আমরা জানতে চাই যে, আপনি আমাদেরকে সত্য বলেছেন আর আমরা তার সাক্ষী থাকতে চাই। মরিয়ম-পুত্র ঈসা বললো, হে আল্লাহ, হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের জন্য আসমান থেকে খাদ্য পরিপূর্ণ খাঞ্চা প্রেরণ করুন, এটা আমাদের আর পরবর্তী সকলের জন্য হবে আনন্দোৎসবস্বরূপ এবং আপনার নিকট থেকে নিদর্শন, আর আমাদেরকে জীবিকা দান করুন আর আপনিই তো শ্রেষ্ঠ জীবিকাদাতা। আল্লাহ বললেন, আমিই তোমাদের কাছে তা প্রেরণ করবো, কিন্তু এর পর তোমাদের মধ্যে কেউ কুফরি করলে তাকে এমন শাস্তি দিবো, যে শাস্তি বিশ্বজগতের অপর কাউকেও দিবো না।” (সূরাহ আল-মাইদাহ, ৫ : ১১২-১১৫)

উপরে উল্লিখিত আয়াতসমূহে পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, হ্যা, আমি তোমাদের কাঙ্ক্ষিত মুজিযা প্রদান করবো, কিন্তু তা প্রদানের পর কেউ তা অস্বীকার করলে তাকে নজীরবিহীন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। “মুজিযা নবুওয়াতের প্রমাণ” – এই অভিমতের সমর্থনে কুরআনের এই আয়াতগুলো অকাট্য ও দ্ব্যর্থহীন প্রমাণ।

(৪) আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেনঃ

“মুসা বললো, আমি তোমার কাছে স্পষ্ট কোন প্রমাণ আনয়ন করলেও ? ফিরআউন বললো, তুমি যদি সত্যবাদী হও তবে তা (প্রমাণ) পেশ করো। এরপর মুসা তার লাঠি নিক্ষেপ করলে তৎক্ষণাৎ তা এক সাক্ষাৎ অজগর হলো। এবং মুসা হাত বের করলো আর তৎক্ষণাৎ তা দর্শকদের দৃষ্টিতে শুভ্র উজ্জ্বল প্রতিভাত হলো। ফিরআউন তার পরিষদবর্গকে বললো, এ তো সুদক্ষ যাদুকর।” (সূরাহ আশ-শুয়ারা, ২৬ : ৩০-৩৪)

উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুসা আলাইহিস সালাম’কে প্রদত্ত মুজিযাকে “স্পষ্ট ব্যাপার” (بشيء مبين) তথা প্রমাণ বলে উল্লেখ করেছেন এবং ফিরআউনও সেটিকে তার নবুওয়াতের দাবীর সত্যতার প্রমাণ হিসেবে উপস্থিত করার জন্য আহবান করেছে। এরপর মুসা আলাইহিস সালাম তার নবুওয়াতের দাবীর সত্যতার প্রমাণ হিসেবে তাকে প্রদত্ত মুজিযা পেশ করেছেন।

(৫) নবী ও রাসুলগণকে প্রদত্ত মুজিযা তাদের নবুওয়াত ও রিসালাতের দাবীর সত্যতার প্রমাণস্বরূপ – এ কথা স্বয়ং আল্লাহ তাআলা মুসা আলাইহিস সালাম’কে প্রদত্ত দুটো মুজিযা সম্বন্ধে স্পষ্টত বলেছেন। যেমন –

“আরো বলা হলো, তুমি তোমার লাঠি নিক্ষেপ করো; এরপর সে যখন সেটাকে সাপের মতো ছুটাছুটি করতে দেখলো তখন পিছনের দিকে ছুটতে লাগলো এবং ফিরিয়ে তাকালো না; তাকে বলা হলো, হে মুসা, সামনে এসো, ভয় করো না, তুমি তো নিরাপদ। তোমার হাত তোমার বগলে রাখো, এটি বের হয়ে আসবে শুভ্র সমুজ্জ্বল নির্দোষ হয়ে; ভয় দূর করার জন্য তোমার হাত দুটো নিজের দিকে চাপিয়ে ধরো; এ দুটো তোমার প্রতিপালক প্রদত্ত প্রমাণ, ফিরআউন ও তার পরিষদবর্গের জন্য; তারা তো সত্যত্যাগী সম্প্রদায়।” (সূরাহ আল-কাসাস, ২৮ : ৩১-৩২)

অতএব, কুরআনের এ জাতীয় সুস্পষ্ট প্রমাণ বর্তমান থাকার পর “মুজিযা প্রমাণ না নিদর্শন” – এ বিষয়ে কোনরূপ মতবিরোধ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই।

 

মুজিযার সত্যতা প্রতিষ্ঠা

হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীর সূচনাক্ষণ পর্যন্ত ইসলামী আকাইদ ও মুজিযা সম্পর্কে বুদ্ধিবৃত্তিক কোন বিতর্কের সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যভাগে যখন গ্রীক দর্শন সম্বলিত গ্রন্থাবলীর আরবী তরজমা মুসলমানদের মধ্যে বিস্তৃতি লাভ করে, তখন এটা ইসলামের ইলমে কালাম তথা আকাইদ তর্কশাস্ত্রের একটি প্রয়োজনীয় বিষয় হিসেবে রচিত হয় এবং এ সমস্ত যুক্তি-তর্কের গুরুত্ব এতোই বৃদ্ধি পায় যে, তখন এই গ্রীক দর্শনের কষ্টিপাথরে যাচাই ছাড়া কোন বিষয়ই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতো না।

গ্রীসের অধিবাসীরা আল্লাহ প্রদত্ত শরীআত সম্বন্ধে পরিচিত ছিল না। তারা ছিল পৌত্তলিক। এজন্য তারা নবুওয়াত, নবুওয়াতের বৈশিষ্ট্য, ওহী, ইলহাম ও মুজিযা সম্পর্কেও ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞ ও অপরিচিত। এ কারণে গ্রীক দর্শনে এ সমস্ত বিষয়ের কোন আলোচনাই স্থান পায়নি। এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবন রুশদ তার “তাহাফাতুত তাহাফুত” নামক গ্রন্থে বিস্তৃত বিশ্লেষণ পেশ করেছেন। আল্লামা ইবন তাইমিয়াও নিজ রচনাবলীতে এ প্রসঙ্গে বিক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করেছেন। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন মুসলিম দার্শনিক শায়খ ইয়াকুব আল-কিন্দী। তার পর দার্শনিক ফারাবীও এ সম্পর্কে যথেষ্ট লেখালেখি করেছেন। তিনি মুজিযা সম্পর্কে লিখেছেনঃ নবুওয়াতের অধিকারী সত্তার রূহের মধ্যে এক ধরণের পবিত্র শক্তির বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। যেমন তোমাদের দেহের মধ্যে তোমাদের প্রানশক্তি রয়েছে এবং তোমাদের দেহ তোমাদের রূহের অনুগত হয়ে থাকে, অনুরূপ সেই পবিত্র শক্তিসম্পন্ন রূহ সার্বিকভাবে বিশ্বের অবয়বধারী বস্তুনিচয়ের মধ্যে ক্রিয়াশীল আছে এবং সমগ্র বিশ্বজগৎ তার প্রতি আনুগত্য ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এবং এ কারণেই পবিত্র রূহানী শক্তিসম্পন্ন সত্তা থেকে সহজাত স্বভাবের অতীত কর্মকাণ্ড প্রকাশ পেয়ে থাকে। এটাই মুজিযা। (দ্রষ্টব্যঃ সিরাতুন্নবী, ৪খ.)

“যে কোন বস্তুর সহজাত স্বভাবের অতীত কর্মকাণ্ডের নাম মুজিযা” – কথাটির ব্যাখ্যা এই যে, প্রত্যেক বস্তুর এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ও নিয়মতান্ত্রিকতা আছে, যা তা থেকে কখনো পৃথক হয় না। যেমন, আগুনের সহজাত বৈশিষ্ট্য হলো ভস্মীভূত করা, সমুদ্রের সহজাত বৈশিষ্ট্য হলো প্রবাহিত থাকা, বৃক্ষের সহজাত স্বভাব হলো স্থির থাকা, পাথরের বৈশিষ্ট্য হলো চলতে না পারা, মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য হলো মৃত্যুর পর পুনরায় দুনিয়াতে জীবিত না হওয়া ইত্যাদি। এখন যদি এমন হয় যে – আগুন ভস্মীভূত করেনি, সমুদ্র স্থির হয়ে রয়েছে ও প্রবাহ নেই, পাথর চলতে শুরু করেছে আর কথা বলতে আরম্ভ করেছে, মৃত জীবিত হয়ে গিয়েছে – তাহলে বলতে হবে যে, এটি পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়মকে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। এটা সেই বস্তুর সহজাত কার্যকরণ সম্পর্কের সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে, প্রাকৃতিক নিয়মাবলীকে পরিবর্তন করে দিয়েছে। এখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে, পৃথিবীর বস্তুনিচয়ের এই সহজাত নিয়মাবলী কি পরিবর্তনযোগ্য ? দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকদের একটি দলের অভিমত এই যে, বস্তুনিচয়ের সহজাত নিয়মতান্ত্রিকতার কোনরূপ পরিবর্তন সম্ভব না। এই ভিত্তিতে তারা মুজিযার অসম্ভাব্যতা প্রতিপন্ন করার প্রয়াস পান। মুসলিম দার্শনিকদের একটি শ্রেণীও এই অভিমত সমর্থন করেছেন। যেমন ফারাবী, ইবন সিনা, ইবন মিসকাওয়ায়হ প্রমুখ। (দ্রষ্টব্যঃ সিরাতুন্নবী ৪খ.)

ইবন তাইমিয়্যা তার “রাদ্দুল মানতিক” নামক গ্রন্থে এবং ইবন হাযম জাহিরী তার “আল ফিসাল ফিল মিলালি ওয়ান নিহাল” নামক গ্রন্থে ফারাবী, ইবন সীনা প্রমুখ দার্শনিকের অভিমতকে পরিত্যাজ্য বলে সাব্যস্ত করেছেন। কারণ “প্রকৃতির সহজাত নিয়মাবলীর পরিবর্তন সম্ভব নয়” কথাটি বাস্তবসম্মত না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, কোন প্রাণীর জন্মের প্রাকৃতিক নিয়ম হলো, এক ফোঁটা বীর্য থেকে রক্ত উৎপন্ন হয়, রক্ত থেকে গোশত উৎপন্ন হয়, এরপর পর্যায়ক্রমে একটি নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত তা মাতৃ উদরে প্রতিপালিত হয়, ফলে তা পরিণত হয় একটি পূর্ণাঙ্গ দেহাবয়বে। এরপর তা নবজাত শিশুরূপে ভূমিষ্ঠ হয় এবং পর্যায়ক্রমে শিশুরূপ ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে এবং পরবর্তীতে সুস্থ, সুডৌল দৈহিক কান্তির অধিকারী একজন শৌর্য-বীর্য সমৃদ্ধ যুবকে রূপান্তরিত হয় এবং তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটায়।

এই হলো একজন মানুষের জন্মের সহজাত প্রাকৃতিক নিয়ম। এখন এই নিয়ম ভঙ্গ করে অর্থাৎ অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায়সমূহ অতিক্রম করা ছাড়া কারো পক্ষে সুদেহী প্রাণী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করাও সম্ভব, মোটেও অসম্ভব না। এ ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিকদের বক্তব্য এই যে, এক ফোঁটা বীর্য রক্তে রূপান্তরিত হতে, এরপর গোশতে, এরপর অস্থি-মজ্জায় ও সুডৌল-সুঠাম থেকে অন্তর্বর্তীকালীন যে পর্যায়গুলো অতিক্রম করার আবশ্যকতা রয়েছে, তা যদি কোনভাবে পূরণ করে দেওয়া যায়, তাহলে উক্ত অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায়গুলো অতিক্রম করা ছাড়াই এক ফোঁটা বীর্য একটি সুঠাম-সুডৌল দেহে রূপান্তরিত হতে পারে। আধুনিক কালে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে নানান ফসলাদির উৎপাদন বিজ্ঞান প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গের প্রকৃষ্ট উদাহারন নয় কি ?

কিছু দার্শনিক মনে করেন, পৃথিবীর ঘটনাবলী কোন না কোন প্রাকৃতিক কার্যকরণ দ্বারাই সংঘটিত হয়ে থাকে। কিন্তু সহজাত প্রকৃতির অতীত কর্মকাণ্ডে এই কার্যকারণ অনুপস্থিত। এই ভিত্তিতেও তারা মুজিযা অস্বীকার করার প্রয়াস পান। এর সমাধান এই যে, হ্যা, যাবতীয় ঘটনার পিছনে কোন না কোন কার্যকারণ ক্রিয়াশীল রয়েছে। কিন্তু এটা তো জরুরী নয় যে, সকল ধরণের প্রাকৃতিক কারণসমূহ আমরা আমাদের জ্ঞান ও মনীষা দ্বারা সার্বিকভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হবো ? কিছু কিছু কার্যকারণ এমনও রয়েছে, যা অতিশয় প্রচ্ছন্ন ও সূক্ষ্ম হওয়ার দরুন স্বভাবত মানুষের জ্ঞান ও মনীষা তা অনুধাবন করতে সক্ষম হয় না। এ পৃথিবীতে অসংখ্য অগণিত সৃষ্টি রয়েছে যার সূক্ষ্ম রহস্যটির যৎসামান্যই মানুষের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব হয়েছে। আবার বহু সংখ্যক এমনও আছে যে, তার কার্যকারণের গুঢ় রহস্য আজও অজানার পর্দার অন্তরালেই রয়ে গেছে। যেমন, নবী-রাসুলগণ চল্লিশ দিন পর্যন্ত একটানা সিয়াম সাধনা করেছেন। এ সময়ের মধ্যে তারা সামান্যতম আহার্য-পানীয় গ্রহণ করেননি। কিন্তু এতেও তাদের শারীরিক শক্তির মধ্যে কোনই পরিবর্তন দেহা দেয় নি। এটা স্পষ্টত আশ্চর্যজনক বিষয়। কিন্তু এ ঘটনাও কার্যকারণ থেকে পৃথক নয়। কেননা, আমরা যদি অনুসন্ধান করি, মানুষের ক্ষুধার তাড়না দেখা দেয় কেন, তাহলে দেখা যাবে যে, মানুষের উদরস্থ হজমশক্তি ভক্ষিত খাদ্যকণাকে পরিপূর্ণরপে হজম করার পর তা থেকে উদ্ভূত রক্ত কনিকাগুলোকে দেহের বিভিন্ন অংশে পৌঁছিয়ে দেয়। তার উদরস্থ হজম শক্তির আর কোন কাজ অবশিষ্ট থাকে না, যার ফলে তার মধ্যে তালাশ করার প্রবণতা প্রবল হয়ে উঠে। এরই ফলে মানুষ ক্ষুধার তাড়না অনুভব করে থাকে।

কিন্তু আমরা চলমান জীবনে এমন অভিজ্ঞতারও সম্মুখীন হই যে, কোন রোগের কারণে অথবা ভয়ভীতির কারণে অথবা গভীর চিন্তায় নিমগ্ন থাকার কারণে আমাদের দেহে এমন এক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, যার প্রভাবে দীর্ঘ কয়েক দিন পর্যন্ত আমাদের পাকস্থলীর হজমশক্তি লোপ পেয়ে যায়। এর ফলে আমরা ক্ষুধার তাড়না অনুভব করি না। ঠিক একই নীতির ভিত্তিতে যদি কোন ব্যক্তির মধ্যে আধ্যাত্মিকতার সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং দৈহিক অবস্থার সাথে তার সম্পর্ক শিথিল হয়, এমতাবস্থায়ও তার শারীরিক শক্তির মধ্যে স্থবিরতা বা শক্তিহীনতা দেখা দিতে পারে। এ ক্ষেত্রেও সে কয়েক দিন পর্যন্ত উপবাস থাকতে পারে।

মোটকথা, আধ্যাত্মিক শক্তির সাথে যখন গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তখন দৈহিক স্বাভাবিক গতিবিধি ও কার্যক্রমের মধ্যে নিস্পৃহ ভাব দেখা দেয়। এই নাজুক লগ্নেও মানুষ দীর্ঘদিন পর্যন্ত উপবাস করে বেঁচে থাকতে পারে। সুতরাং এই সহজাত প্রকৃতির বরখেলাপ কার্যপ্রবাহকে যদি স্বীকার করে নিতে কষ্ট না হয়, তাহলে অতি প্রকৃত আধ্যাত্মিক শক্তির পরিপূর্ণ বিকাশ মুজিযাসমূহকে অস্বীকার করার কোনই কারণ থাকতে পারে না। (সিরাতুন্নবী, ৪খ.)

বস্তুত কার্যকারণ সম্পর্কের উপর সর্বাঙ্গীণ অভিজ্ঞতা মানুষের নেই। মানুষ যা কিছু জানার সুযোগ লাভ করেছে, তার তুলনা বিশাল সমুদ্রের এক ফোঁটা পানি অথবা তা থেকেও স্বল্প ও ক্ষীণ। উপরন্তু মানুষ যা কিছু জানার ও অনুধাবন করার সুযোগ পেয়েছে, তাও পৃথিবীর কিছু বস্তুর চলমান গতি-প্রকৃতির সামান্য নিরীক্ষা মাত্র। তার হাকিকতও প্রকৃত জ্ঞান নয়। মানুষ জ্ঞানের এই সীমানায় পৌঁছতে অক্ষম যে, বস্তুটি কেন চলছে আর যদি বস্তুটি বিপরীত দিকে চলতো তাহলে কি কি অসামঞ্জস্য প্রকাশ পেতো ? এ কারণেই পৃথিবীর স্বনামধন্য বৈজ্ঞানিকগণ একবাক্যে এ কথা স্বীকার করে নিয়েছেন যে, তারা কেমন প্রশ্নটির উত্তর দিতে সক্ষম, কিন্তু কেন প্রশ্নটির যথার্থ উত্তর দেওয়া তাদের আলোচ্য বিষয়ের বাইরে। উদাহারনস্বরূপ বলা যায়, পানি কেমন ? এর উত্তর বৈজ্ঞানিকগণ তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পানি কেমন ? এই প্রশ্নের উত্তর তারা দিতে পারেননি, এমনকি এই প্রশ্নের আলোচনাও তারা করেননি।

প্রকৃত সত্য এই যে, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকগণ কার্যকারণ সম্বন্ধে যে মতাদর্শ দৃঢ়ভাবে আঁকড়িয়ে ধরেছেন, বস্তুত এটির পরিণতি অজ্ঞতা ও বুদ্ধিহীনতা বৈ কিছু নয়। কারণ তাদের বিশ্বাস যে, এই বস্তুটি এই কার্যকারণ ও উপাদানে সৃষ্টি হয়েছে। এটি ছাড়া এই বস্তুটি অস্তিত্বে আসতেই পারে না। যেমন বীর্য থেকে প্রাণের উৎপত্তি, ডিম থেকে পাখির উৎপত্তি, উদ্ভিদের উৎস বীজ, তাদের বিশ্বাসের এই সমস্ত উপাদান ছাড়া এসব বস্তু অস্তিত্বে আসার কথা কল্পনাও করা যায় না। এখানে আমাদের প্রশ্ন যে, দুনিয়ার প্রথম প্রাণী, প্রথম পাখি এবং প্রথম উদ্ভিদ কি বীর্য, ডিম ও বীজ ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছে ? এর উত্তরে যদি তারা “হ্যা” বলেন, তাহলে তো তারা নিজেদের দাবী ও মতাদর্শের বিপরীত সাক্ষ্য প্রদান করবেন। আর যদি এটা অস্বীকার করেন, তাহলে এ কথাও তাদেরকে অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হবে যে, প্রথম বীর্য, প্রথম ডিম ও প্রথম বীজ, প্রাণী, পাখী, উদ্ভিদ ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছে।

মোটকথা, এই লক্ষ্যমাত্রাকে কখনো বিজ্ঞান তার বুদ্ধির শাণিত অস্ত্র দ্বারা নির্মূল করতে পারবে না। এমতাবস্থায় কার্যকারণ সম্পর্কিত কিছু দর্শন ও মতাদর্শ তাদেরকে অবশ্যই পরিহার করতে হবে। পাশাপাশি তাদেরকে এ কথারও স্বীকৃতি দিতে হবে যে, এক মহাশক্তিমান ইচ্ছাশক্তির অস্তিত্ব অবশ্যই বর্তমান রয়েছে, যার ইচ্ছা ও নির্দেশে বিশ্বজগতের এই কারখানা পরিচালিত হচ্ছে। উপরন্তু তাকে এ কথাও মেনে নিতে হবে যে, কার্যকারণ সম্পর্কে সেই মহান শক্তিমান সত্তার ইচ্ছা এবং নির্দেশ বিকাশের বাহ্যিক দৃষ্টান্ত ছাড়া অতিরিক্ত আর কিছু না। বস্তুত কার্যকারণও তার সার্বভৌম ইচ্ছার অধীন। পবিত্র কুরআনে এ কথাই বিবৃত হয়েছেঃ

“……. জেনে রাখো, সৃজন ও আদেশ তারই; মহিমাময় বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ।” (সূরাহ আল-আরাফ, ৭ : ৫৪)

সুতরাং বিশ্বজগতের সবকিছুর পিছনে আল্লাহ’র কুদরত এবং তার ইচ্ছাই হলো মূল কারণ।

আল্লামা রুমী বলেছেন, বাহ্যিক কারণসমূহের উপর হাকীকী ও মৌলিক কারণসমূহের নিয়ন্ত্রাণাধিকার থাকে। সুতরাং হে দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ, তোমরা বাহ্যিক কারণসমূহ দেখে অভিভূত হয়ো না, বরং হাকীকী ও মৌলিক কারণসমূহ সম্পর্কেও গভীর চিন্তা-গবেষণা করো। কেননা, নবীগণ বাহ্যিক কারণ ও উপাদান সম্পর্ককে পরিহার করে নিজেদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যান এবং আল্লাহ প্রদত্ত মুজিযা ও অলৌকিক শক্তির ঝাণ্ডা সর্বত্র সমুন্নত করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তাই দেখা যায়, কোন কার্যকারণ সম্পর্ক ছাড়াই তারা গহীন সমুদ্রকে দ্বিধাবিভক্ত করে নিজেদের চলার পথ রচনা করেন এবং কৃষিক্ষেত-খামার ছাড়াই গম ও যবের ফসল লাভ করেন। এমনকি পবিত্র কুরআনে যে দিকনির্দেশনা মূর্ত হয়ে উঠেছে, তাও এই যে, কার্যকারণ সম্পর্ক শক্তিহীন ও নিষ্ক্রিয়। এজন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে বিজয়ী হয়েছেন এবং তারই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পার্শ্বে আবু জাহল হয়েছে ধ্বংস। এভাবে ক্ষুদ্র আবাবিল পাখীর প্রস্তর খণ্ডে আবিসিনিয়ার হস্তিবাহিনী হয়েছে পর্যুদস্ত। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রস্তর কণা আবাবীলের চঞ্চু থেকে নিক্ষিপ্ত হতো হস্তিবাহিনীর উপর, ফলে দীর্ণ-বিদীর্ণ এবং ঝাঁজরা করে দিতো চর্বিত তৃণলতার মতো।

মোটের উপর পবিত্র কুরআনে আগাগোড়া এ কথাই তুলে ধরা হয়েছে যে, কার্যকারণ সম্পর্কিত চলমান দুনিয়ার বাহ্যিক কারণের মধ্যে কোনই মৌলিক ক্ষমতা ও শক্তি নেই। মূল কার্যকারণের নিয়ন্ত্রণকারী মহান আল্লাহ নিজ ইচ্ছানুসারে বাহ্যিক কার্যকারণের মধ্যে কখনো কখনো কার্যকরী শক্তি ও ক্ষমতার বিকাশ ঘটিয়ে থাকেন। তথাপি এই বিকাশ কারণসম্ভুত নয়, বরং আল্লাহ প্রদত্ত গুণাবলীর বাহ্যিক প্রতিফলন মাত্র। (মসনবী)

 

এ পর্যন্ত আমরা যা কিছু আলোচনা করেছি তার সারমর্ম এই যে, সহজাত স্বভাবকে এবং কার্যকারণ সম্পর্কের নিয়মতান্ত্রিকতাকে সর্বতোভাবে পরাজিত করা নাম হচ্ছে মুজিযা, যা মহান আল্লাহ নিজ মনোনীত পয়গাম্বরের সত্যতার প্রমাণস্বরূপ মানুষের সম্মুখে প্রকাশ করে থাকেন। দ্বিতীয় কথা এই যে, সহজাত স্বভাবের বিপরীত কোন কিছু সংঘটিত হওয়া এবং কার্যকারণ সম্পর্কের বাঁধন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে যে, কোন বিষয়ের জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্ভাব্যতা তার কার্যত সংঘটিত হওয়ার দলীল বহন করে না, বরং কোন বিষয়ের কার্যত সংঘটিত হওয়াকে কবুল করার জন্য নিন্মোক্ত শর্তাবলীর উপস্থিতি অপরিহার্য –

(১) বর্ণনাকারীর সন্দেহাতীত প্রত্যক্ষ করা এবং গ্রহণযোগ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া;

(২) বর্ণনাকারীর সত্যবাদী হওয়া এবং তার স্মৃতিশক্তি তীক্ষ্ণ ও সূক্ষ্ম হওয়া, তার মধ্যে প্রতারণা ও প্রবঞ্চনার প্রবণতা না থাকা;

(৩) বর্ণনাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমগুণ সম্পন্ন বর্ণনাকারীদের দ্বারা বিবৃত হওয়া;

(৪) উপরন্তু এই প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা ও প্রাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ অবিচ্ছিন্ন ধারায় সকল যুগের নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের সূত্র-পরম্পরায় সংরক্ষিত হয়ে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছা।

এখন উল্লিখিত নীতি ও মানদণ্ডের আলোকে আমাদের দেখতে হবে যে, হাদিস, ইতিহাস ধর্মীয় কিতাবাদিতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে সমস্ত মুজিযার বর্ণনা লিপিবদ্ধ রয়েছে, তাতে উপরোক্ত শর্তানুসারে দলীল-প্রমাণ ও সাক্ষ্য পাওয়া যায় কিনা ?

আমাদের উসুলে হাদিসে প্রত্যেকটি রিওয়ায়াত গ্রহণ করার জন্য উপরে উল্লিখিত নীতিসমূহকে পূর্বশর্তরূপে নির্ধারণ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুজিযাত সম্পর্কে যে সকল সাহাবী প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য প্রদান করেছেন, তাদের সত্যবাদিতা, জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা, স্মরণশক্তি ও সুষ্ঠ বিচার-বিশ্লেষণী প্রতিভার প্রমাণ সর্বজন স্বীকৃত। তাদের কাছ থেকে পরবর্তী সময়ে যে সমস্ত মুহাদ্দিসীনে কেরাম উক্ত বর্ণনাসমূহ নকল করেছেন তাদের সত্যবাদিতা, জ্ঞান-বুদ্ধি ও তীক্ষ্ণ ধীশক্তির কথা আসমাউর রিজাল এর কিতাবসমূহে বিস্তারিতভাবে সুসংরক্ষিত রয়েছে। উপরন্তু তাদের সামনে সর্বদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই সতর্ক হুঁশিয়ারি বারবার ঝংকৃত হতো –

“যে ব্যক্তি আমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে, তার ঠিকানা হবে দোযখ।” (মুসলিম, ১খ.)

এ কারণে তারা যখনই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সম্পর্কিত কোন বক্তব্য রিওয়ায়াত করতেন, তখন পরিপূর্ণ মানবিক সচেতনতা এবং বিশেষ বিবেচনার সাথে তা বর্ণনা করতেন। তবে যেহেতু প্রকৃতিগতভাবে সকলের সচেতনতা ও স্মৃতিশক্তি সমান নয়, সেহেতু সার্বিক সতর্কতা আর মনোনিবেশের পরও সকলের বর্ণনা একই মূল্যমানের হওয়া সম্ভব ছিল না। এ কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সম্পর্কিত মুজিযার বর্ণনাসমূহ নির্ভরযোগ্যতার মাত্রা বা স্তর বিবেচনায় কম-বেশী হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার ছিলো, কিন্তু আমাদের সচেতন মুহাদ্দিসীনে কেরাম অক্লান্ত পরিশ্রম ও পরিপূর্ণ আমানতদারির সাথে নিরপেক্ষ বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে দুর্বল বর্ণনাসমূহকে সহিহ বর্ণনাসমূহ থেকে পৃথক করতে সক্ষম হয়েছেন এবং এই মানদন্ডের দ্বারা সত্যতা ও যথার্থতা প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

সারকথা এই যে, মুজিযার সত্যতা প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠার জন্য প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যপ্রমাণ বিদ্যমান থাকা একান্ত জরুরী। সহিহ মুজিযাতই পরবর্তী সাক্ষ্য-প্রমাণ সম্বলিত রিওয়ায়াতসমূহ এতোই মজবুত ও সুদৃঢ় যে, দুনিয়ার কোন বর্ণনা তার মুকাবিলা করতে সক্ষম না। এর ফলে মুজিযার অকাট্যতা আর সহজাত প্রকৃতির বহির্ভূত কর্মকাণ্ডের বাস্তবতাকে কেউই অস্বীকার করতে পারে না।

 

মুজিযা ও কারামাতের মধ্যে পার্থক্য

মুজিযা নিয়ে আলোচনা পূর্বেই হয়ে গেছে। এখন কারামাত বলতে কি বুঝায় এবং মুজিযা ও কারামাতের পার্থক্য তুলে ধরা হবে।

كرامة (কারামাত) শব্দটি كرم ধাতুমূল থেকে গঠিত হয়েছে। এর অর্থ – উদার, দয়ালু, সম্মানিত হওয়া। আল্লাহ পাকের অসংখ্য গুণবাচক নামের মধ্যে “কারীম” একটি গুণবাচক নাম। আল-কুরআনে এটি একাধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ পাক সেখানে আল-কারীম (الكريم) অর্থাৎ উদার বা দয়ালু নামে আখ্যায়িত হয়েছেন। তবে কারামাত বলতে যা বুঝায়, আল-কুরআনে উল্লিখিত আল-কারীম শব্দ তা বুঝায় না।

কারামাত (كرامة) শব্দটির বহুবচন কারামাত (كرامات)।  ধর্মীয় পরিভাষায় এর অর্থ – আল্লাহ’র দেওয়া দান, যা সম্পূর্ণ মুক্ত, অবারিত অনুগ্রহ (ইহসান বা ইনআম)। তবে যথাযথ ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে এভাবে যে, আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহপূর্বক তার প্রিয়জনদেরকে অলৌকিক ঘটনা সম্পাদন করার যোগ্যতা প্রদান করে থাকেন। আর তারাও আল্লাহ পাকের অনুকম্পাসিক্ত হয়ে অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ করেন। এটিই কারামাত নামে অভিহিত। এ সমস্ত ঘটনা সাধারণত বস্তুজগতে সংঘটিত বিস্ময়কর ঘটনার সমন্বয়ে ঘটিত নতুবা ভবিষ্যতের কোন পূর্ব সংকেতস্বরূপ অথবা আধ্যাত্মিক বিষয়ের কোন ব্যাখ্যাস্বরূপ। (ইসলামী বিশ্বকোষ, ৭ম খ.)

মুজিযা ও কারামাতের সংজ্ঞা থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, মুজিযা ও কারামাতের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য আছে। তবে আউলিয়ায়ে কিরামগণের দ্বারা কারামাত প্রকাশ পাওয়া আদৌ সঠিক কিনা, সে ব্যাপারে আলিমগণ মতভেদ করেছেন।

মুতাযিলি মতবাদঃ অধিকাংশ মুতাযিলি সম্প্রদায় কারামাতের বাস্তবতাকে অস্বীকার করে। তাদের প্রসিদ্ধ যুক্তি, যা আল-কুরআনের সুপ্রসিদ্ধ ভাষ্যকার জারুল্লাহ যামাখশারী কর্তৃক ৭২ : ২৬-২৭ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় আলোচিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন –

“তিনি অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা, তিনি তার অদৃশ্যের জ্ঞান কারো কাছে প্রকাশ করেন না; – তার মনোনীত রাসুল ব্যতীত, সে ক্ষেত্রে আল্লাহ রাসুলের অগ্রে ও পশ্চাতে প্রহরী নিয়োজিত করেন।” (সূরাহ আল-জিন্ন, ৭২ : ২৬-২৭)

আল-কুরআনের এ আয়াত থেকে যামাখশারী বুঝাতে চান যে, আল্লাহ তাআলা তার প্রেরিত নবীগণের মিশনের সত্যতা সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে তাদের দ্বারা প্রকাশ্যভাবে বিভিন্ন রকমের অলৌকিক ব্যাপার প্রকাশ করেন, কিন্তু অন্য সকল অতি-প্রাকৃত ঘটনা তিনি সৃষ্টির অগোচরে সম্পন্ন করেন। আল জুব্বাঈ বলেন, ওয়ালীগণ যদি এই ক্ষমতার অধিকারী হোন তাহলে কিভাবে তাদেরকে নবীগণ থেকে পৃথক করা যাবে ?

এভাবে মুতাযিলি সম্প্রদায় কারামাতের যথার্থতা অস্বীকারের ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন।

দার্শনিকগণের অভিমতঃ দার্শনিক ইবনে সীনার দৃষ্টান্ত থেকে কারামাতের স্বীকৃতি পাওয়া যায়। তার সৃষ্টিতত্ত্ব “অপরিহার্য ও আত্মসচেতন ইচ্ছাসম্পন্ন” উদ্ভবের অস্তিত্বমূলক অদৃষ্টবাদের মধ্যে মুজিযাত ও কারামাতকে তিনি স্থান দিয়েছেন। নবীগণ তাদের মানবীয় প্রকৃতির পরিপূর্ণতা ও বাহ্যিক বস্তুনিচয়ের উপর প্রকৃতিগত আত্মিক প্রভাবেই মুজিযা দ্বারা তাদের আগমনকে সুনিশ্চিত করে থাকেন। উল্লেখ্য যে, ইবন রুশদ তার “তাহাফুতুত তাহাফুত” গ্রন্থে (সম্পা. Bouyes, 515) একটি পার্থক্য উল্লেখ করেছেন। তা হলো, যার মধ্যে গুনগত পার্থক্য নিহিত শুধু সেগুলোই অলৌকিক ঘটনা। কারণ সাধারণ মানুষের পক্ষে তা অসম্ভব হলেও প্রকৃতপক্ষে তা সম্ভব। তার রিসালা ফি আকসামিল উলুম গ্রন্থে (তিসউর রাসাইলের অন্তর্ভুক্ত, কায়রো সংস্করণ, ১৩২৬/১৯০৪) ইবনে সিনা বলেন, কারামাত প্রকৃতিগতভাবে মুজিযার সমার্থক। তার ইশারাত গ্রন্থে (সম্পা. Foger Leiden, ১৮২০ খৃ.) তিনি এ কথা সমর্থন করেন যে, আধ্যাত্মিক গভীরতার কল্যাণে যার আত্মা জাগতিক বস্তুর উপর প্রভাবশীল এবং যিনি এই প্রভাব কল্যাণকর ও নীতিসিদ্ধ পন্থায় ব্যবহার করেন, যদি তিনি নবী হোন তাহলে আল্লাহ’র দান হিসেবে তিনি তা লাভ করেন, সেটিই মুজিযা। আর যদি তিনি ওলী হোন, তাহলে তিনি কারামাতের সৌভাগ্য অর্জন করেন। নবীগণ নবুওয়াতপ্রাপ্ত হোন আল্লাহ’র প্রতি তাদের প্রকৃতিগত সহজাত প্রবৃত্তি, প্রজ্ঞার ত্রিবিধ পরিপূর্ণতা, চিন্তাশক্তি ও কঠোর সত্যনিষ্ঠার মাধ্যমে, যদিও সেই সাধনা বা মুজিযা নিন্ম মানের হয়। (ইসলামী বিশ্বকোষ, ৭ম খ.)

আশআরী সম্প্রদায়ের জবাবঃ ধারণা করা হয়, কিছু সংখ্যক আশআরী, যেমন – আল ইসফারাইনী, আল হালিমী প্রমুখ কারামাত প্রসঙ্গে মুতাযিলি সম্প্রদায়ের জোরালো মতামত বা বিচার-বিবেচনাকে সমর্থন করে। তবে আশআরী সম্প্রদায়ের সাধারণ মতবাদের যথার্থতা নিন্মে বর্ণিত যুক্তির ভিত্তিতে স্বীকৃত –

(ক) বুদ্ধিবৃত্তিক সম্ভাব্যতাঃ কোন নবীর নৈতিক পরিপূর্ণতার নিদর্শন কোন অলৌকিক ঘটনা বা মুজিযা অহেতুক না, বরং তা আল্লাহ পাকের সদিচ্ছা বা কার্যকর ইচ্ছা। তিনি তার সেই ইচ্ছাকে একজন নবীর মাধ্যমে সম্পাদন করে থাকেন। সেই অলৌকিক কাজটি সম্পাদিত হয় কোন ঘোষণা বা চ্যালেঞ্জের মুকাবিলায়। সুতরাং আল্লাহ পাকের পক্ষে কোন বিজ্ঞপ্তি বা চ্যালেঞ্জ ছাড়াই কোন সাধকের মাধ্যমে অতি প্রাকৃত কোন ঘটনা ঘটানো বৈধ বা জায়েজ।

(খ) আল-কুরআনের সমর্থনঃ এমন কতগুলো ঘটনার অস্তিত্ব দিবালোকের মতো দেদীপ্যমান ও যথার্থ বলে প্রমাণিত, কুরআন মাজিদে যা উল্লেখ হয়েছে, যার ধারকগণ কোন নবুওয়াতের দাবীদার ছিলেন না, যেমন –

“….. যখনই যাকারিয়া কক্ষে তার সাথে সাক্ষাৎ করতে যেতো, তখনই তার কাছে খাদ্য-সামগ্রী দেখতে পেতো; সে বলতো, এসব তুমি কোথায় পেলে ? সে বলতো, তা আল্লাহ’র কাছ থেকে, নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রিযিক দান করেন।” (সূরাহ আলি ইমরান, ৩ : ৩৭)

সন্দেহাতীতরূপে ঘটনাটি ছিল বিস্ময়কর, অলৌকিক। ঈসা আলাইহিস সালামের মা মারিয়াম নিজে কোন নবী ছিলেন না, নবুওয়াতের দাবীদারও ছিলেন না, অথচ তার কাছে পাওয়া যেতো অসম মৌসুমে মৌসুমী ফল। আরো উল্লেখ হয়েছে –

“তুমি কি মনে করো যে, গুহা ও রাকীমের অধিবাসীরা আমার নিদর্শনাবলীর মধ্যে বিস্ময়কর ?” (সূরাহ আল-কাহফ, ১৮ : ৯)

যারা একটি পার্বত্য গুহাতে একাধারে তিনশত বছর ঘুমন্ত ছিলেন, তারা নবী-রাসুল নন, অথচ এ সকল ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘটনা আল্লাহ’র পক্ষ থেকে অলৌকিক নিদর্শন। আরো উল্লেখ পাওয়া যায় –

“কিতাবের জ্ঞান যার ছিলো, সে বললো, আপনি চোখের পলক ফেলার আগেই আমি তা আপনাকে এনে দিবো; সুলায়মান যখন তা সামনে রক্ষিত অবস্থায় দেখলেন তখন বললেন, এটি আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ ….” (সূরাহ আন-নামল, ২৭ : ৪০)

ঘটনাটি ঘটেছিলো সুলায়মান আলাইহিস সালামের আদেশে হয় একজন জিন্ন বা কোন বিজ্ঞ ব্যক্তির মাধ্যমে (নোটঃ তাফসীরে ইবনে কাসিরে এই ব্যক্তির মানুষ হওয়ার পক্ষেই মত দেখা যায়, বিস্তারিত দেখুন তাফসীরে ইবনে কাসিরে এই আয়াতের তাফসীরে), যারা কোন নবী ছিলেন না যিনি চোখের পলকে রানী বিলকিসের বিরাট সিংহাসন এনেছিলেন অনেক দূর থেকে।

সুতরাং কারামাত সম্ভব, তাবে তাকে মুজিযার সাথে সংযুক্ত করা কোনক্রমেই সঙ্গত হবে না। আল্লাহ মুজিযা প্রকাশ করেন নবীগণের মিশনের প্রমাণস্বরূপ, আর কারামাতকে প্রকাশ করেন ওলীগণকে সম্মানিত ও তাদের ধর্মনিষ্ঠা ও তাকওয়া সংরক্ষণ মানসে। মুজিযাত সকল মানুসের সামনে প্রকাশ করা উচিৎ, তবে কারামাত গোপন করাই বিধেয়। সর্বদা দুটোর মধ্যে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পার্থক্য বজায় রাখা কর্তব্য। জেনে রাখতে হবে, যাবতীয় ঐন্দ্রজালিক বিদ্যা এটা থেকে ভিন্নতর। উল্লেখ্য যে, আশআরী মতবাদ আরো বিধৃত হয়েছে – ইবন খালদুন, মুকাদ্দিমা, অনু ৬খ. ; DE Slane, ১খ. , ৪৩খ. ; অনু. Rosenthal, ১খ. , ৯১খ. গ্রন্থসমূহে।

(গ) সূফী মনস্তত্ত্ব কর্তৃক স্বীকৃতঃ ওলীগণের কারামাত সূফী দার্শনিকগণ কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে। সুন্নী সূফী বিদ্যায় পারদর্শীগণ কর্তৃক প্রদত্ত ব্যাখ্যা সাধারণভাবে আশআরী মতবাদের খুবই নিকটবর্তী। এই মতবাদে কারামাত ও মুজিযার পার্থক্যের উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কোন ওলী-দরবেশ বিস্ময়কর কার্যাবলী সম্পাদন করলে তিনি সে কারণে নবী হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করতে পারেন না। তিনি তদানীন্তন রাসুল কর্তৃক প্রবর্তিত ধর্মীয় আইনের অনুশাসন মানতে বাধ্য থাকেন।

কারামাত কখনো মুজিযার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে না, বরং মুজিযার পৃষ্ঠপোষকতা করে। মনে রাখতে হবে যে, ওলীগণের কারামাত সেই নবীর মুজিযার প্রমাণ, যে নবীর তিনি উম্মত। সে কারণে মুজিযা নবীর সত্যতার প্রতীক। আমরা দেখতে পাই, খুবাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু’কে অবিশ্বাসীরা যখন মক্কাতে শূলীতে দেয়, তখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক দূরে মদিনার মসজিদে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সহচরবৃন্দ পরিবেষ্টিত অবস্থায় উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্তর্দৃষ্টিতে দেখলেন খুবাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু’র উপর জুলুম-অত্যাচারের করুণ অবস্থা। সহচরবৃন্দকে তা সবিস্তারে অবহিত করেন। অপরদিকে আল্লাহ পাক খুবাইবের অন্তরায় দূরীভূত করেন। তিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র দর্শন লাভ করেন, তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সালাম পেশ করেন, তিনিও (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সালামের জবাব দেন, খুবাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু সালামের জবাব শুনতে পান। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জন্য দুয়া করেন। মক্কা-মদিনার মধ্যে দূরত্ব ছিল বিস্তর। তবুও তাদের মধ্যে সাক্ষাৎ, সালাম আদান-প্রদান সুনিশ্চিতরূপে অস্বাভাবিক ব্যাপার। এটি খুবাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু’র জন্য ছিল কারামাত আর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য ছিল মুজিযা। (দাতা গনজে বখশ, কাশফুল মাহজুব)

 

ইসতিদরাজ

ইসতিদরাজ শব্দটি সাধিত হয়েছে “দারজ” ধাতুমূল থেকে। ইসতিদরাজ অর্থ ধোঁকা দেওয়া, প্রতারণা করা। আবার ইসতিদরাজ অর্থ শনৈঃ শনৈঃ নিকটবর্তী হওয়া। বলা হয়, ইসতাদরাজাল্লাহুল আবদা, অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা ধীর গতিতে বান্দার নিকটবর্তী হলেন। এর অর্থ, বান্দা যখন নিত্য-নতুন পাপ কর্মে লিপ্ত হয়, আল্লাহ’ও তখন নতুন নতুন নিয়ামতরাশি দিয়ে তাকে পরিতুষ্ট করেন, তাকে ভুলিয়ে দেন ক্ষমা প্রার্থনা করতে। যেমন, আল্লাহ বলেছেন –

“আর যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা অভিহিত করেছে, আমি অচিরেই তাদেরকে আস্তে আস্তে এমনভাবে পাকড়াও করবো যে, তারা বুঝতেই পারবে না।” (সূরাহ আল-আরাফ, ৭ : ১৮২)

এ কারণেই উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু’র সামনে যখন বাদশাহ কিসরার ধনভাণ্ডার আনা হলো, তখন তিনি আল্লাহ’র কাছে দুয়া করেছিলেন – ইয়া আল্লাহ, ইসতিদরাজকারী হওয়া থেকে আমি আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি; যেহেতু আমি আপনার ঘোষণা শুনেছি যে আপনি বলেছেন, “আমি অচিরেই তাদেরকে আস্তে আস্তে এমনভাবে পাকড়াও করবো যে, তারা বুঝতেই পারবে না”। (আল-যাবীদী, তাজুল আরুস, ৫খ.)

ধোঁকা ও প্রবঞ্চনার দ্বারা মানুষকে ধীরে ধীরে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার প্রক্রিয়াকে আরবী পরিভাষায় ইসতিদরাজ বলে। সিহর, যাদু, ইন্দ্রজাল, সম্মোহন, ভেল্কীবাজি, নজরবন্দী ইত্যাদি পরিভাষাগত ইসতিদরাজ। যাদুকররা সম্মোহন বা ইন্দ্রজালের দ্বারা মানুষকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করে। আস্তে আস্তে মানুষ তাদের খপ্পরে পড়ে।

অস্বাভাবিক কার্যকলাপ দিয়ে মানুষকে প্রতারণা করে। ফলে এটিও অলৌকিক মুজিযা বা কারামাতের পর্যায়ে বিবেচিত হয়, তবে এটি শরীআত সমর্থিত না।

মুফতি মুহাম্মাদ ইউসুফ বলেন, যে অস্বাভাবিক ক্রিয়া-কর্ম কোন ফাসিক পাপী বিধর্মী কাফির থেকে প্রকাশ পায়, তাকে প্রতারণা বা ইসতিদরাজ বলে। একজন ফাসিক ফাজির থেকে এ রকম অলৌকিক কাজ প্রকাশ পাওয়া একটি ফিতনা আর মানুষের জন্য মহাপরীক্ষা। (মুফতি মুহাম্মাদ ইউসুফ, যাওয়াহিরুল ফারাইদ)

মুজিযা, কারামাত ও ইসতিদরাজের মধ্যে পার্থক্য – কারামাত শব্দের ভাবার্থ মুজিযা থেকে ভিন্নতর। তবে বিষয় দুটোই বস্তুর স্বাভাবিক নিয়মকানুন ভঙ্গের সাথে জড়িত। তা একটি বিস্ময়কর ঘটনা যা আল্লাহ’র নিয়ম-কানুনের (সুন্নাতুল্লাহ) স্বাভাবিক ধারাকে লঙ্ঘন করে। তা যদি নবী-রাসুলের মাধ্যমে প্রকাশ পায় তাহলে মুজিযা, আর যদি কোন ওলীর মাধ্যমে প্রকাশ পায় তাহলে কারামাত বলে অভিহিত হয়।

আল্লামা জুরজানী বলেন, “নবী নন – এমন কোন মুসলিম ব্যক্তি থেকে যদি অস্বাভাবিক কিছু প্রকাশ পায় তাহলে তা কারামাত। আর প্রকাশিত বিষয় যদি ঈমান ও পুণ্য কর্মের সহায়ক না হয়, তবে তা ইন্দ্রজাল। আর যদি অনুরূপ ঘটনা প্রকৃতই নবুওয়াতের দাবীদার থেকে প্রকাশ পায় তাহলে তা মুজিযা বলে অভিহিত।” (কিতাবুত তারীফাত)

আল্লামা শাব্বির আহমাদ বলেন, মুজিযা এবং কারামাত দুটোই সুসম্পন্ন হয় আল্লাহ’র পক্ষ থেকে। মুজিযা একজন নবী থেকে আর কারামাত একজন ওলী থেকে প্রকাশ পায়। এ দুটোই শিক্ষন-প্রশিক্ষণের ঊর্ধ্বে। দুটোরই কারণ একমাত্র আল্লাহ।

আল্লাহ’র অন্যান্য ক্রিয়াকর্মের মতো মুজিযাও একটি কর্ম যা সাধারণ নিয়মনীতির ঊর্ধ্বে। তিনি তার ইচ্ছার অধীন মুজিযাকে কার্যকর করে থাকেন। পক্ষান্তরে যাদু বা ইন্দ্রজাল এমনই একটি বিষয়, যার জন্য যথারীতি শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। যে কেউ এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবে তার দ্বারাই বিস্ময়কর ও আশ্চর্যজনক কার্যাদি প্রকাশিত হবে। অথচ মুজিযা শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে কোন শিক্ষাসার বা পাঠ্যসূচি, কোন নীতিমালা রচিত হয়নি। পক্ষান্তরে ইন্দ্রজাল বা সম্মোহন বিদ্যা শিক্ষার জন্য বই-পুস্তক রচিত হয়েছে, যার অধিকাংশই হিন্দু ধর্মাবলম্বী লোকদের দিয়ে রচিত। আজ যদি প্রতিদিন কেউ ঈসা আলাইহিস সালামের কথা “আল্লাহ’র হুকুমে উঠে দাঁড়াও” হাজারবারও মুখে আওড়ায়, তবুও কোন মৃত উঠে দাঁড়াবে না। মুসা আলাইহিস সালামের লাঠি দিয়ে মাটিতে লক্ষবার আঘাত করলে বা মাটিতে নিক্ষেপ করলেও কোনরূপ মুজিযাই প্রকাশ পাবে না – না সাপে পরিণত হবে, না পানির ঝর্ণা প্রবাহিত হবে। কারণ শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের দ্বারা মুজিযাকে আয়ত্ত করা যায় না।

মুজিযা প্রদর্শনকারী নবী মুজিযা প্রকাশ হওয়ার পূর্বে তার রূপ-প্রকৃতি সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেন না। পক্ষান্তরে, যাদুকর তার যাদুর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত থাকে। মুজিযার জন্য কোন সময়ও নির্ধারিত থাকে না। পক্ষান্তরে যাদু নির্দিষ্ট স্থান ও কালের মুখাপেক্ষী। মুসা আলাইহিস সালামের প্রতিদ্বন্দ্বী ফিরআউনের যাদুকররা রশির উপর মন্ত্র পাঠ করার আগেই জানতো যে, রশিতে মন্ত্র পড়ে ছেড়ে দিলে তা সাপে পরিণত হবে। এ কারণেই যাদুর প্রতিক্রিয়াতে সাপ দেখার পরও তাদের মধ্যে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি, বরং তাদের যাদুর প্রতিক্রিয়া প্রদর্শনে দর্শকদের কাছ থেকে তারা বাহবা লুটছিল, আনন্দে বিভোর ছিল।

অপরদিকে, লাঠি নিক্ষেপের জন্য মুসা আলাইহিস সালামের উপর আদেশ হলে তিনি লাঠি নিক্ষেপ করলেন, সাথে সাথে তা পরিণত হলো একটি বিরাট অজগর সাপে, যা দেখে মুসা আলাইহিস সালাম ভীত-বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। এরপর প্রত্যাদেশ হলো – হে মুসা, তা ধারণ করো, ভীত হয়ো না, আমি তাকে পূর্বাকৃতিতে পরিবর্তিত করবো। তার ভীত সন্ত্রস্ত হওয়ার কারণ একটিই ছিল যে, তিনি আগে থেকে জানতেন না যে, লাঠি ছেড়ে দিলে তার প্রতিক্রিয়া কি হবে। সুতরাং মুজিযার রূপ-প্রকৃতি সম্পর্কে আল্লাহ পাকই সর্বজ্ঞ।

যাদুবিদ্যায় শয়তান অংশগ্রহণ করে। এ কারণেই একজন অভিজ্ঞ যাদুকর অশ্লীলতার শিরোমনী সর্বশ্রেষ্ঠ দাজ্জাল। আর মুজিযার শিরোমনী খতমে নবুওয়াত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। সুতরাং এই দুটো কল্যাণ ও অকল্যাণ, আলো ও আঁধারকে এই নশ্বর জগতে জড়াজড়ি করে রাখা একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা।

 

মুজিযা ও ইসতিদরাজের মধ্যে পার্থক্য

পূর্ববর্তী আলোচনায় মুজিযার সংজ্ঞা, স্বরূপ ও তাৎপর্য এবং ইসতিদরাজের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তাতেই মুজিযা ও ইসতিদরাজ এবং নবী ও যাদুকরের মধ্যে তারতম্য সুস্পষ্ট রূপে বিশ্লেষিত হয়েছে। যাদু, সম্মোহন বা ভেল্কিবাজি শুধু হাসি-কৌতুকের সাময়িক প্রহসন মাত্র। পক্ষান্তরে মুজিযা বা নিদর্শন হলো বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর সংস্কার ও ধ্বংস, নির্মাণ ও বিনষ্ট, উন্নতি ও অবনতির উপায় উপাদান। যাদুকরের উদ্দেশ্য থাকে, যাদুর প্রহসন দ্বারা কোন অসাধারণ ঘটনাকে শুধু বিস্ময়কর পদ্ধতিতে প্রতিহত করা, যাতে সে কিছুক্ষণের জন্য দর্শকমণ্ডলীকে বিস্ময়াভিভূত করে দিতে পারে। পক্ষান্তরে একজন নবীর উদ্দেশ্য থাকে সেই বিস্ময়কর নিদর্শনাবলীর মাধ্যমে বিশ্বজোড়া সংস্কার সাধন, জাতিকে চিরসত্যের পথে আহবান, গোত্রসমূহকে কৃষ্টি ও ঐতিহ্য ঐশ্বর্যশালী হওয়ার শিক্ষাদান ও আল্লাহ’র দ্বীনকে সুদৃঢ় করা। নবী-রাসুলগণ হলেন সুসংবাদদাতা, ভীতি প্রদর্শনকারী, পূত-পবিত্রকারী, উজ্জ্বল আলোক বর্তিকা ও বিশ্ববাসীর সাক্ষ্যদাতা। আর যাদুকর এ সকল গুণের দিক থেকে সম্পূর্ণ রূপে বঞ্চিত।

পবিত্র কুরআনে যাদুমন্ত্র সম্পর্কে যা আলোচিত হয়েছে তাতে স্পষ্ট বুঝা যায় আল-কুরআন যাদু-মন্ত্রের অস্তিত্ব বা প্রতিক্রিয়াকে স্বীকার করে, কিন্তু তা অনুমোদন বা সমর্থন করে না। একটি ধাঁধা বা সম্মোহন ব্যতীত তার কোন গুরুত্বই দেয় না। লক্ষ্য করা যায়, হারুত-মারুত ঘটনায় যাদুর শক্তি ও ক্ষমতার সীমা সম্পর্কে বলা হয়েছে –

“….. তারা উভয়ের (হারুত-মারুত) কাছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যা বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে তা শিক্ষা করতো, অথচ আল্লাহ’র নির্দেশ ছাড়া তারা কারো কোন ক্ষতিসাধন করতে পারতো না, তারা যা শিক্ষা করতো তা তাদের ক্ষতিসাধন করতো, কোন উপকারে আসতো না …… ” (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ : ১০২)

“….. তাদের যাদুর প্রভাবে অকস্মাৎ তার (মুসার) মনে হলো তাদের দড়ি ও লাঠিগুলো ছুটাছুটি করছে।” (সূরাহ তো-হা, ২০ : ৬৬)

মুসা আলাইহিস সালামের সামনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী যাদুকররা প্রথমে তাদের যাদু দেখালে এরকম ঘটনা ঘটেছিলো। এরপর আল্লাহ’র পক্ষ থেকে মুসা আলাইহিস সালামের প্রতি প্রত্যাদেশ হলো –

“আমি বললাম, ভয় করো না, তুমিই প্রবল। তোমার ডান হাতে যা আছে তা নিক্ষেপ করো, তারা যা করে তা গ্রাস করে ফেলবে, তারা যা করেছে তা তো কেবল যাদুকরের কলাকৌশল, যাদুকর যেখানেই আসুক সফল হবে না।” (সূরাহ তো-হা, ২০ : ৬৮-৬৯)

আল্লাহ যাদুকর ও নবীর মধ্যে যে পার্থক্য নিরূপণ করেছেন তা হলো – নবী কৃতকার্য হোন আর যাদুকর হয় অকৃতকার্য। নবীর কার্যকলাপ চেষ্টা-সাধনা ও মুজিযার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে সফলকাম ও কল্যাণধর্মী হওয়া। অপরপক্ষে যাদুকরের উদ্দেশ্য হলো ধোঁকাবাজি, প্রবঞ্চনা ও অনিষ্ট সাধন করা। অপর একটি আয়াতে এ ব্যাখ্যারই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। মিসরীয় যাদুকরদেরকে লক্ষ্য করে মুসা আলাইহিস সালাম বললেন –

“….. তোমরা যা এনেছো তা যাদু, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে অসার করে দিবেন; নিশ্চয়ই আল্লাহ অশান্তি সৃষ্টিকারীদের কর্ম সার্থক করেন না।” (সূরাহ ইউনুস, ১০ : ৮১)

যাদু ও তন্ত্রমন্ত্র একটি সাময়িক ক্রীড়া-কৌতুক। আর মুজিযার প্রভাব, ক্রিয়াশীলতা সার্বজনীন ও সর্বকালীন। এ জগতে তার ফলাফল অত্যন্ত ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। মুসা আলাইহিস সালামের মুজিযা দেখে ফিরআউন যখন বললো, এটা তো সব যাদুমন্ত্রের লীলাখেলা। জবাবে মুসা আলাইহিস সালাম বললেন –

“…. এটি কি যাদু ? যাদুকররা তো সফলকাম হয় না।” (সূরাহ ইউনুস, ১০ : ৭৭)

পৌত্তলিক অবিশ্বাসীরা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে বলাবলি করতো, এই লোকটি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শয়তানী শক্তির সাহায্যে এসব বাণী পেশ করছে, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাণীর উৎস হলো শয়তানী শিক্ষা। তার জবাবে আল্লাহ পাক তাদেরকে জানিয়ে দিলেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীর উৎসমূল ভালো না মন্দ, শয়তানী শক্তির বহিঃপ্রকাশ না ফেরেশতা শক্তির ফল – এই তত্ত্ব ও তথ্যটি অনুধাবন করা খুবই সহজ। স্বয়ং আহবানকারীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবন, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চরিত্র ও কার্যকলাপ সেটার উজ্জ্বল সাক্ষী। ঈসা আলাইহিস সালামের ভাষায় বৃক্ষের পরিচয় ফল দ্বারাই। সুতরাং শয়তানী ও আসমানি উচয় শক্তির মধ্যে তারতম্য নিরূপণ করা মোটেই কষ্টসাধ্য নয়। আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন শয়তান কার কাছে যায় –

“তারা তো অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক ঘোর মিথ্যাবাদী ও পাপীর উপর। তারা কান পেতে থাকে আর তাদের অধিকাংশই মিথ্যাবাদী।” (সূরাহ আশ-শুয়ারা, ২৬ : ২২২-২২৩)

আসল ও নকল নবীর মধ্যে তারতম্য নিরূপণের নিমিত্ত তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চারিত্রিক জীবনই যথেষ্ট। এতদ্ব্যতীত মিথ্যাবাদী ও অপবাদ রটনাকারী ও অসৎ চলাফেরা কম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, দীর্ঘস্থায়ী কিংবা চিরন্তন হয় না। যেমন আল-কুরআন ঘোষণা দেয় –

“…. নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করবে তারা সফলকাম হবে না। তাদের সুখ-সম্ভোগ সামান্যই আর তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি।” (সূরাহ আন-নাহল, ১৬ : ১১৬-১১৭)

(আল্লামা শিবলী নুমানী, সিরাতুন্নবী, ৩খ.)

 

সূত্রঃ সিরাত বিশ্বকোষ – একাদশ খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)

0 Reviews: